Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মর্গে শুয়েই ছেলের অপেক্ষায় মৃত বাবা, নিঃসঙ্গ শহরের করুণ ছবি

পুলিশ সূত্রের দাবি, ছেলে বা দাদা দেশে ফিরলে নিয়ম মেনে দেহ হস্তান্তর করা হবে।পুলিশ সূত্রের খবর, রবিবার সকাল সা়ড়ে আটটা নাগাদ কাঁকুড়গাছির সিআইটি রোডের একটি আবাসনের ফ্ল্যাট থেকে তরুণ দাসের (৬২) পচন ধরে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৫১
Share: Save:

একই হাসপাতালে রয়েছেন কাঁকুড়গাছির দাস দম্পতি। স্বামী তরুণ দাসের দেহ পড়ে রয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। স্ত্রী রত্না দাস ট্রমা কেয়ার সেন্টারে চিকিৎসাধীন। সোমবার পুলিশ জানিয়েছে, তরুণবাবুর দেহ নেওয়ার জন্য পরিবারের কেউ এখনও আসেননি। জার্মানিতে তরুণবাবুর একমাত্র ছেলে অভীক এবং নিউজিল্যান্ডে তরুণবাবুর দাদা বারীন দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মানিকতলা থানা। দু’জনই জানিয়েছেন, দেশে ফিরতে ক’দিন সময় লাগবে তাঁদের।

পুলিশ সূত্রের দাবি, ছেলে বা দাদা দেশে ফিরলে নিয়ম মেনে দেহ হস্তান্তর করা হবে।পুলিশ সূত্রের খবর, রবিবার সকাল সা়ড়ে আটটা নাগাদ কাঁকুড়গাছির সিআইটি রোডের একটি আবাসনের ফ্ল্যাট থেকে তরুণ দাসের (৬২) পচন ধরে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পাশেই রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় স্ত্রী রত্নাদেবীকে। তাঁর পেটের ক্ষত দেখে পুলিশের ধারণা, রত্নাদেবী ফল কাটার ছুরি জাতীয় কিছু দিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, স্বামীর মৃত্যুর পরে জার্মানিতে থাকা ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন রত্নাদেবী। কিন্তু ছেলে এসে না পৌঁছনোয় কাউকে কিছু জানাননি। রবিবার সকালে এক পরিচিত রত্নাদেবীকে ফোন করে কিছু আঁচ করেন এবং তিনিই পুলিশকে খবর দেন।

এই ঘটনায় ফের সামনে এসেছে শহরে প্রবীণ দম্পতিদের নিঃসঙ্গতার সমস্যা। গত মার্চ মাসে পর্ণশ্রীতে এমনই একটি ঘটনা সামনে এসেছিল। দীর্ঘদিন রোগভোগের পরে মারা যান বৃদ্ধা মীনাক্ষী রায় (৬২)। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মঘাতী হন তাঁর স্বামী রথীন্দ্রনাথ রায় (৭৩)। তাঁর সুইসাইড নোটে উঠে এসেছিল স্ত্রীর দীর্ঘকালীন অসুস্থতা এবং সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কথা। পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা রথীন্দ্রনাথের আর্থিক সমস্যা ছিল না। কিন্তু নিঃসঙ্গতা গ্রাস করেছিল ওই দম্পতিকে। এ ক্ষেত্রেও ছেলের সঙ্গে দূরত্ব এবং নিঃসঙ্গতাই রত্নাদেবীকে এমন আচরণের দিকে ঠেলে দিয়েছিল বলেই মনে করছেন পুলিশ এবং মনোবিদদের একাংশ।

ওই আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশ জানান, কয়েক বছর আগে টাকা জোগাড় করে ছেলেকে বিদেশে পাঠান তরুণবাবু। তার পর থেকে ছেলেকে ফিরতে দেখেননি তাঁরা। ঠিকাদারি ব্যবসা করে তরুণবাবু অসুস্থ হয়ে প়ড়ার ফলে রোজগারও কমে গিয়েছিল। আগে পড়শিদের সঙ্গে মেলামেশা করলেও রত্নাদেবী ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: ২০০ টাকার জন্য শিশু খুন? শ্যামবাজারের ম্যানহোলকাণ্ডে নতুন সূত্র

শহরে এই ঘটনার পিছনে পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়ার ছবিই দেখছেন সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা মল্লিকা সরকার দাসের মতে, ছেলেমেয়েরা চাকরি সূত্রে বাইরে চলে যাচ্ছেন। পিছনে পড়ে থাকছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। এই পারিবারিক বন্ধন আলগা হওয়ায় ক্রমশ শূন্যতা গ্রাস করছে ওঁদের। মল্লিকাদেবী বলেন, ‘‘অনেক সময়েই এক জন মারা গেলে অন্য জন অবলম্বনহীন হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পান না।’’ সমাজতত্ত্ববিদদের অনেকে এ-ও বলছেন, উচ্চাকাঙ্ক্ষার পিছনে দৌড়নোর ফলেই এই পিছুটান ও পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ আলগা হয়ে পড়ছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু অবশ্য বলছেন, এই ফিরে না আসার পিছনে বিদেশে গিয়ে সন্তানের ব্যর্থতাও দায়ী হতে পারে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ধারদেনা করে বিদেশে গিয়েও অনেকে সে ভাবে সফল হতে পারেননি। সেই ব্যর্থতার ফলে দেশেও ফিরতে পারেন না তাঁরা। অনেক সময়ে ফিরে আসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও হাতে থাকে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Morgue R G Kar Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE