Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সাইবার আদালতে বহু মামলা ঝুলে, হয়রানি

ডিভোর্স চেয়ে এক তরুণীকে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল, যুবতীর মোবাইলে সফ্‌টওয়্যার ঢুকিয়ে আড়ি পেতেছিলেন তিনি। তাতেই ওই তরুণীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের হদিস পাওয়া গিয়েছে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:০২
Share: Save:

ডিভোর্স চেয়ে এক তরুণীকে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল, যুবতীর মোবাইলে সফ্‌টওয়্যার ঢুকিয়ে আড়ি পেতেছিলেন তিনি। তাতেই ওই তরুণীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের হদিস পাওয়া গিয়েছে। স্ত্রীর ফোনে আড়ি পাতা হ্যাকিংয়ের সমান। সেই অভিযোগ নিয়ে ২০১৪-এ তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের সাইবার আদালতের (অ্যাডজুডিকেশন) দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্ত্রী। শুনানি শেষ হলেও কোনও রায় বেরোয়নি।

কাঁকুড়গাছির বাসিন্দা ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। ডিভোর্স পেতে স্ত্রী তাঁর কম্পিউটার হ্যাক করে নানা তথ্য বিকৃত করে অপবাদ দিচ্ছেন, এই অভিযোগে ২০১৩ সালে সাইবার অ্যাডজুডিকেশনে মামলা করেছিলেন তিনি। ইন্দ্রনীলবাবু বলছেন, দু’বছর আগে শেষ বার শুনানি হয়েছিল। বিরোধী পক্ষ হ্যাকিংয়ের কথা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে আর কিছুই হয়নি। এমনও হয়েছে যে মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। কিন্তু সেই চিঠি এসে পৌঁছেছে শুনানির দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরে। সুরাহার অপেক্ষায় এখনও দিন গুনছেন তিনি।

সাইবার অপরাধের শিকারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া-সহ নানা দেওয়ানি বিচারের জন্য সব রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের অধীনে এই বিশেষ আদালত বা অ্যাডজুডিকেশন খোলা হয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যের সেই আদালতে মামলা জমেই রয়েছে। ফলে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও বিচার পাচ্ছেন না বহু মানুষ। টালিগঞ্জের বাসিন্দা মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাক’ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার পরে ২০১৫-এ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে মামলা করেছিলেন তিনি। বলছেন, ‘‘মাস আটেক আগে শেষ শুনানি হয়েছিল। শুনেছিলাম, চূড়ান্ত শুনানি হবে। এখনও তা হয়নি।’’ মামলা ঝুলে থাকা ওই ব্যক্তি বলছেন, ‘‘সেপ্টেম্বর থেকে নির্দেশের অপেক্ষায় বসে আছি। এখনও কিছু হল না।’’

সাইবার আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০০২ সালে বম্বে হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সাইবার অ্যাডজুডিকেশন তৈরির কথা বলা আছে। কিন্ত কোথাও তা নেই। তার পরেই বম্বে হাইকোর্ট রায় দেয়, মহারাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তি দফতরকে এই বিশেষ আদালত তৈরি করতে হবে। তার মাথায় থাকবেন তথ্যপ্রযুক্তি সচিব। বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকার সব রাজ্যকেই এই বিশেষ আদালত তৈরি করতে হবে। সাইবার মামলার এই বিশেষ আদালত ফৌজদারি বিচার করতে পারে না। তবে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারে। রাজ্য সরকারের সাইবার কৌঁসুলি বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া মানুষদের বড় ভরসার জায়গা এই আদালত। এখানে বিচার না পেলে মানুষ যাবেন কোথায়?’’

অনেকে আবার বলছেন, রাজ্য সরকার বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির উপরে জোর দিচ্ছে। তার জন্য জাতীয় স্তরে পুরস্কারও জিতেছে অর্থ দফতর। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে রাজ্যে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প আনার ব্যাপারে উৎসাহী। সে ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের অধীনে থাকা আদালতই কেন নাগরিকদের সুবিচার দিতে এত দেরি করছে? সাইবার বিশেষজ্ঞদের একাংশের কথায়, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বাড়লে এই ধরনের নানা সমস্যা বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের এই আদালতকে আরও তৎপর হতে হবে। রাজ্যের এক সাইবার বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘‘মুম্বই ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে কিন্তু অ্যাডজুডিকেশন সক্রিয়।’’

তা হলে এ রাজ্যের এমন দশা কেন? এ ব্যাপারে রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য, ‘‘বহু মামলা দায়ের হয়েছে। বকেয়া মামলাগুলি দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে।’’ তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গোড়ার দিকে তথ্যপ্রযু্ক্তি সচিব বদল হওয়ায় অনেক শুনানি কেঁচে গণ্ডুষ করতে হয়েছিল। তার ফলেই মামলার শুনানি পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু পিছিয়ে থাকা মামলার শুনানি শেষ করতে বর্তমান সচিব তৎপর হননি কেন, তার কোনও সদুত্তর ওই সূত্র দিতে পারেনি।

মামলার আবেদনকারীদের অনেকেরই বক্তব্য, শুনানির দিন ধার্য করা নিয়েও নানা সময়ে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়েছে। ইন্দ্রনীলবাবু বলছেন, ‘‘কারণ যা-ই হোক না কেন, ভুগতে তো হচ্ছে আমাদেরই।’’

আমজনতার এই ভোগান্তি কবে শেষ হয়, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyber Crime Court Delay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE