Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আগুনে ছাই ৩০টি পরিবারের ভবিষ্যৎ

রাস্তার ধারে পোড়া বাক্সটা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন বছর চব্বিশের সারিকুল সর্দার। অনেক ক্ষণ ধরে খোঁজার পরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ওই যুবক। আর্তনাদ করে বললেন, ‘জমানো টাকার কানাকড়িও নেই!’

প্রয়াস: তখনও নেভেনি আগুন। তার মধ্যেই সম্বল বাঁচানোর চেষ্টায় দমকলকর্মীরা। মঙ্গলবার, ডানলপ পার্কিং এলাকায়। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

প্রয়াস: তখনও নেভেনি আগুন। তার মধ্যেই সম্বল বাঁচানোর চেষ্টায় দমকলকর্মীরা। মঙ্গলবার, ডানলপ পার্কিং এলাকায়। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৬
Share: Save:

রাস্তার ধারে পোড়া বাক্সটা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন বছর চব্বিশের সারিকুল সর্দার। অনেক ক্ষণ ধরে খোঁজার পরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ওই যুবক। আর্তনাদ করে বললেন, ‘জমানো টাকার কানাকড়িও নেই!’

প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে তা বিক্রি করে কয়েক বছর ধরে এক লক্ষ টাকা জমিয়েছিলেন সারিকুল। ইচ্ছে ছিল, ক্যানিংয়ের বেদবেড়িয়ায় কিছুটা জমি কিনবেন। মঙ্গলবার সকালে ডানলপ পার্কিং এলাকার ঝুপড়িতে আগুন লাগার সঙ্গে সারিকুলের স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। শুধু ওই যুবকই নন। এ দিনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়েছে প্রায় ৩০টি ঝুপড়ি। দমকলের ১০টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে এসে প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভায়। তবে ধ্বংসস্তূপ সরাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

বরাহনগর স্টেশনের পাশেই বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে। তার ধারে ছোট্ট ফাঁকা জায়গার মধ্যেই ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুপড়ি বানিয়ে বসবাস করে ১২৫টি পরিবার। ঝুপড়ি ঘেঁষেই রয়েছে ডানলপ নর্দার্ন পার্কের বেশ কয়েকটি বহুতল। বরাহনগর পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ওই ঝুপড়ি এলাকাকে স্থানীয়েরা ডানলপ পার্কিং নামেই চেনেন। মূলত মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোকজনই থাকেন এই ঝুপড়িতে। প্লাস্টিকের বোতল, কাচের শিশি কুড়িয়ে তা বাছাই করে বিক্রি করা, পরিচারিকার কাজ, রিকশা চালিয়েই তাঁদের দিন কাটে।

এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ ডানলপের দিকে থাকা একটি ঝুপড়ি ঘরে প্রথম আগুন লাগে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। প্লাস্টিকের ছাউনি, দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে ও আশপাশে ডাঁই করা প্লাস্টিক, কাচের বোতলেও আগুন ধরে যায়। এক যুবক বিলে সাহা বলেন, ‘‘প্রচণ্ড ধোঁয়া দেখে ছুটে এসে কয়েক জনকে উদ্ধার করি। কিছু জিনিসপত্রও বার করে আনি।’’

বাসিন্দারা জানান, প্রায় চার-পাঁচটি গ্যাস সিলিন্ডার ফাটতেই আগুনের মাত্রা বেড়ে যায়। তীব্র তাপে ঝুপড়ি সংলগ্ন বহুতলের জানলার কাচ ভেঙে ভিতরে আগুন ঢুকে যায়। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় গোটা ডানলপ এলাকা। নর্দার্ন পার্কের বাসিন্দাদের সংগঠনের সম্পাদক প্রতীপ গুহ জানান, আগুন ছড়াচ্ছে দেখে সব বহুতল থেকে বাসিন্দাদের নামিয়ে আনা হয়। রাস্তায় বার করে আনা হয় গ্যাস সিলিন্ডার, আভেন,— সব কিছু। এক বহুতলের বাসিন্দা অরুণ সারৌগী বলেন, ‘‘আমাদের আবাসনের তেতলার ফ্ল্যাটের মালিক সুশীল পারলিয়াল সুরাতে থাকেন। ওঁর ঘর পুরো পুড়ে গিয়েছে। তালা ভেঙে ঢুকে দমকলকে জল ঢালতে হয়েছে।’’

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঝুপড়ির এক দিকে আগুন নিভছে তো আর এক দিকে ধরছে। পুড়ে গিয়েছে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধারে থাকা গাছও। আগুনের তাপে ভেঙে পড়ছে পাশের বহুতলের জানলার কাচ। দমকলের পাশাপাশি স্থানীয় যুবকেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে স্থানীয় খাল থেকে বালতি করে জল এনে ঢালছেন ঝুপড়িতে। আবার বহুতলের দেওয়াল ঠান্ডা করতে জলের ট্যাঙ্কগুলিও খুলে দেওয়া হয়।

আগুন থেকে কোনও মতে কয়েকটা বাক্স বাঁচাতে পেরে তা নিয়েই বরাহনগর স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিলেন মুসলিমা বিবি, মঞ্জিলা বিবিরা। তাঁরা জানান, বাচ্চাদের গায়ে দেওয়ার মতো একটা জামাও বাঁচাতে পারেননি। বারুইপাড়ায় পরিচারিকার কাজে যাওয়া নয়ন সাহা খবর পেয়ে পোড়া ঘরের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘‘সব শেষ। খাবার খাওয়ার মতো একটা থালাও নেই।’’ ঘটনাস্থলে আসেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু। তিনি বলেন, ‘‘ঝুপড়িতে প্লাস্টিকের মতো দাহ্য বস্তু মজুত থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও তা-ই হয়েছে। বারবার নিষেধ করা হলেও মানুষ নিয়ম মানেন না। তবে দমকলকর্মীরা তৎপরতার সঙ্গে কাজ করায় কেউ হতাহত হননি।’’

বনহুগলি কলেজের পড়ুয়ারাও ঘটনাস্থলে এসে জল-বিস্কুট বিতরণ করেন। জেলার বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হয়। বরাহনগরের চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিক বলেন, ‘‘বিধায়কের সঙ্গে কথা বলে ঝুপড়িবাসীদের থাকার জন্য স্থানীয় কলেজের কর্মী-আবাসনে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁদের চাল, শুকনো খাবার-সহ সব কিছু দেওয়া হচ্ছে।’’

আগুনের জেরে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের দক্ষিণেশ্বরমুখী রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় কিছু ক্ষণ যানজট হয়। কী ভাবে আগুন লাগল, জানতে তদন্তে আসবেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fire Accident Slum Dunlop
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE