Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অর্ডার দিলেই মাদকের ‘হোম ডেলিভারি’

রবিবার ওই এলাকার অমিত রায় নামে এক যুবকের মৃত্যুর পরে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রো়ডের একটি চায়ের দোকানে ভাঙচুর চালায় উত্তেজিত জনতা। মারধর করা হয় পুলিশকে। সেই ঘটনার পরে সোমবার ওই বস্তিতে গেলে মাদকের এই হোম ডেলিভারির কথা জানান বাসিন্দারাই।

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:০৪
Share: Save:

বাড়ি বসে অর্ডার দিলে দুধের প্যাকেট, পিৎজা, বিরিয়ানি, সবই মেলে। কিন্তু তাই বলে মাদকেরও ‘হোম ডেলিভারি’? শুধু ডেলিভারিই নয়, দক্ষিণ কলকাতার রংকল, মাদারতলা, ঝোড়োবস্তির কিছু কিছু বা়ড়িতে বয়ে এসেই শিরায় মাদক রস চালানোরও ব্যবস্থা রয়েছে!

রবিবার ওই এলাকার অমিত রায় নামে এক যুবকের মৃত্যুর পরে প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রো়ডের একটি চায়ের দোকানে ভাঙচুর চালায় উত্তেজিত জনতা। মারধর করা হয় পুলিশকে। সেই ঘটনার পরে সোমবার ওই বস্তিতে গেলে মাদকের এই হোম ডেলিভারির কথা জানান বাসিন্দারাই। এবং এই প্রসঙ্গেই পুলিশের কাছে উঠে এসেছে অনিল ও সন্টু নামে দুই যুবকের নাম। রবিবার রাতের গোলমালের পর থেকে তারা দু’জনেই এলাকাছাড়া। মাদারতলা বস্তির বাসিন্দা জিন্নত বিবির অভিযোগ, ‘‘অনিল ও সন্টু বাড়িতে এসে আমার স্বামীকে ড্রাগস দিত।’’ দিন কয়েক আগে সময়মতো মাদক না পেয়ে মারা গিয়েছেন জিন্নতের স্বামী আমির আলি পেয়াদা।

মাদকের চক্করে পড়ে প্রাণ না যাক, পা গিয়েছে সাহেব আলি মোল্লার। এক সময়ে গল্ফ ক্লাবে ‘ক্যাডি’-র কাজ করতেন। কিন্তু নেশার জন্য সেই কাজ খুইয়েছেন তিনি। ইঞ্জেকশন নিতে নিতে হাতের শিরা কালো হয়ে গিয়েছিল। তাই পায়ের শিরায় সিরিঞ্জ ফুঁড়তেন। পায়ে পচন ধরে। প্রাণ বাঁচাতে বাঁ পা গোড়ালি থেকে বাদ দিতে হয়েছে। এ দিন বস্তির ঘরের সামনে দাঁড়িয়েই বলছিলেন, ‘‘২৫-২৬ বার নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন পা বাদ যাওয়ায় শিক্ষা হয়েছে। নেশা আর করছি না।’’ ওই এলাকার আরও দুই ভাই এখনও নেশামুক্তি কেন্দ্রে রয়েছেন। এই মারণ নেশার প্রভাব এমনই যে, কচিকাঁচাদের মুখেও ‘পাতা’র ফিরিস্তি।

কী রসে বুঁদ হচ্ছেন ওই এলাকার যুবকেরা, তাও এ দিন জানিয়েছেন বস্তিবাসীরা। তাঁরা বলছেন, ১০ মিলিগ্রাম বিশেষ ধরনের ‘অ্যান্টি-অ্যালার্জিক’ ওষুধের শিশিতে মাদকের গুঁড়ো মিশিয়ে গরম করা হয়। তার পরে সিরিঞ্জ দিয়ে সেই মাদক শিরা ফুঁড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শরীরে। প্রথম দিকে দিনে একটি শিশিতেই নেশা পুষিয়ে যায়। কিন্তু যত দিন গড়ায়, ততই বাড়তে থাকে চাহিদা। পুলিশ জেনেছে, বাড়ি বয়ে এসে নেশা করাতে অনিল, সন্টুরা ৫০০ টাকা করে নেয়। ওই এলাকার বাসিন্দারাই বলছেন, শুধু গরিব বস্তিবাসী নন, নেশার টানে অনিল, সন্টু কিংবা সঞ্জীব ওরফে হুলোর (যার দোকান রবিবার রাতে জনরোষে ছারখার হয়েছে) খোঁজে আসেন উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও।

কিন্তু নেশা ছাড়ানোর তো অনেক উপায় আছে। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও রয়েছে। তা হলে খাস কলকাতার একটি এলাকায় এমন অবস্থা কেন?

পুলিশ জানিয়েছে, ওই এলাকার বহু যুবককে নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়েছে। সঞ্জীবও তার মধ্যে ছিল। কিন্তু দিন কয়েক আগেই নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যায় সে। জিন্নত যেমন জানান, তাঁর স্বামী কেরলে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাদকের টানে সেই চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন। নেশামুক্তি কেন্দ্রেও ভর্তি করা হয়েছিল আমিরকে। কিন্তু ফিরে এসেই আবার নেশায় বুঁদ হয়ে পড়তেন তিনি। সেই মাদক বিষ শিরায় চালান করার চক্করেই ঘর, পরিবার, মুরগির দোকান সব গিয়েছে অমিতের।

পুলিশের একাংশ বলছে, মাদকাসক্তদের নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠালেও অনেক সময়ে পরিবারের লোকেরাই ক’দিন পরে ছাড়িয়ে আনতেন। চিকিৎসা সম্পূর্ণ না হওয়ায় নেশার কবল থেকে বেরোতে পারেন না ওই এলাকার তরুণেরা। ডিসি (এসএসডি) রূপেশ কুমার বলেন, ‘‘ওই এলাকায় মাদকবিরোধী প্রচার আরও জোরালো করা হবে। নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য পরিবারের লোকেদেরও সচেতন করা হবে।’’

তবে পুলিশের অনেকে এ-ও বলছেন, সচেতনতার পাশাপাশি মাদক দমন অভিযানও জোরালো করা প্রয়োজন। এর আগে কয়েক বার সঞ্জীবকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে সে জেলে থেকে ছাড়া পায়। রবিবার রাতের গোলমালের পর থেকে ফের তল্লাশি শুরু হয়েছে। রবিবার রাতে পুলিশকে মারধরের ঘটনায় রবি ছেত্রী নামে রংকল বস্তির এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা ফেরার বলে দাবি পুলিশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drugs Drug Abuse Home Delivery
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE