Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সিরিলের সাতরঙা স্বপ্নেই ভরসা রাজ্যের

কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া ফ্রকের ছেঁড়া হাতাটা ধরা হাতের মুঠোয়। স্কুলের পেল্লাই গেটের খাঁজখোঁজ দিয়ে উঁকি মারছে কলকাতার ফুটপাথের বাসিন্দা ছোট্ট উলোঝুলো চেহারাগুলো। ভেতরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। সম্পন্ন পরিবারের ফিটফাট ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করে।

বদলের কারিগর। ছবি: সুমন বল্লভ

বদলের কারিগর। ছবি: সুমন বল্লভ

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share: Save:

কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া ফ্রকের ছেঁড়া হাতাটা ধরা হাতের মুঠোয়। স্কুলের পেল্লাই গেটের খাঁজখোঁজ দিয়ে উঁকি মারছে কলকাতার ফুটপাথের বাসিন্দা ছোট্ট উলোঝুলো চেহারাগুলো। ভেতরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। সম্পন্ন পরিবারের ফিটফাট ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করে। হাঁ করে তাকিয়ে দেখে ফুটপাথের পুঁচকেরা।

এক দিন বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা মাত্রই খুলে গিয়েছিল সেটা। ধপধপে সাদা পোশাকের এক ভিনদেশি সন্ন্যাসিনী বেরিয়ে এসে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন হতভম্ব খুদেদের। বসিয়ে দিয়েছিলেন ধোপদুরস্ত পড়ুয়াদের সঙ্গে এক বেঞ্চে। সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসা সিস্টার সিরিল মুনির হাত ধরে ‘রেনবো প্রোগ্রাম’-এর বিচ্ছুরণ শুরু হয়েছিল কলকাতার এক স্কুলে।

সেটা আশির দশক। তত দিনে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেদাভেদে তিতিবিরক্ত সিস্টার। তিনি চেয়েছিলেন সার্বিক-সমন্বিত শিক্ষা। যেখানে সমাজের সর্ব স্তরের শিশুরা পাবে সম মানের শিক্ষা। কিন্তু বাস্তবে উন্নত শিক্ষার সব সুযোগ নিয়ে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু সম্পন্ন পড়ুয়া। বাকিরা দিশেহারা। দগদগে এই বিভেদরেখা মুছে ফেলতেই লরেটো হাউজ (শিয়ালদহ) স্কুলের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সিস্টার সিরিল নিজের স্কুলে চালু করেছিলেন প্রথাভাঙা শিক্ষাপ্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে শহরের ফুটপাথবাসী, বস্তিবাসী চালচুলোহীন পরিবারের শিশুরা জায়গা পাবে নামী ইংরাজিমাধ্যম স্কুলে।

তারাই ‘রেনবো চিলড্রেন’। অর্থ, সামাজিক অবস্থান বা প্রাক-শিক্ষার শর্ত অপ্রয়োজনীয়। নিখরচায় তারা রেগুলার স্কুলে পড়বে। প্রয়োজনে স্কুলের আবাসনে থাকবে। বইখাতা-খাবার-জামাকাপড় পাবে। থাকবে টিউশনের ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদের বোঝানোর দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের।

শুধু লরেটো (শিয়ালদহ) স্কুলেই হাজার দেড়েক পড়ুয়ার মধ্যে এখন সাড়ে সাতশোর বেশি ফুটপাথ বা বস্তি থেকে উঠে আসা নিম্নবিত্ত পরিবারের। সম্পন্ন পরিবারের সহপাঠীদের সঙ্গে মিলেমিশেই তারা পড়াশোনা করে। স্কুলের হোমে থাকে ২৫০ জন। পাশ করার পর সামাজিক সম্মান পেতে তেমন অসুবিধা হয়নি কারও। ৩৭ বছর পেরিয়ে সিস্টার সিরিলের সেই ‘রেনবো প্রজেক্ট’ এখন চলছে ভারতের অসংখ্য স্কুলে।

শুধু বাদ ছিল পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলি। দেরিতে হলেও জগদ্দল নড়েছে। সর্বশিক্ষা অভিযানের যুগে ‘রেনবো’-র প্রাসঙ্গিকতা বোঝানো গিয়েছে শিক্ষা দফতরকে। বাংলা, উর্দু ও হিন্দি মাধ্যম মিলিয়ে কলকাতার ২৫টি সরকারি স্কুলে এখন সর্বশিক্ষা মিশনের টাকায় শুরু হয়েছে পথশিশুদের পড়াশোনা। সিস্টার সিরিলের সাতরঙা ভাবনাই মডেল। স্কুলের হোমে তারা নিখরচায় থাকছে। পাচ্ছে প্রয়োজনের জিনিসপত্র।

কলকাতার ১৫টি সরকারি স্কুলে ২০১২ সালে ফুটপাথবাসী দেড় হাজার ছেলেমেয়ে নিয়ে শুরু হয় কাজ। তিন বছরে তা ছড়িয়ে পড়েছে আরও ১০টি স্কুলে। হোমের পড়ুয়া সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার। প্রথমে ঠিক হয়েছিল ৬ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা এই প্রকল্পের আওতায় পড়বে। রাজ্য সরকার পরে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে একে। টাকা জোগাচ্ছে শিক্ষা দফতরই।

এই জুলাইয়ে আশি ছুঁয়েছেন সিস্টার সিরিল মুনি। রবিবার সকালে লরেটো (এন্টালি) স্কুলে তাঁর এখনকার আবাসে বসে বলছিলেন, ‘‘পরীক্ষা নিয়ে, মেধা বিচার করে এই ছেলেমেয়েদের ভর্তি নিই না আমরা। ভর্তির সময়ে বেশির ভাগেরই অক্ষরজ্ঞান থাকে না। তা-ও যে বয়সে তাদের যে ক্লাসে পড়া উচিত, সেই ক্লাসেই ভর্তি নেওয়া হয়। ওই ক্লাসের উপযোগী করে তোলার ভার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, আর তার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাঁদের। আজ পর্যন্ত এতে কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি।’’

লরেটো (শিয়ালদহ) স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল পদ থেকে অবসরের পর সিস্টার সিরিল এখন সরকারি আবাসিক স্কুল প্রকল্পে রাজ্য সরকারের উপদেষ্টা। কলকাতার সর্বশিক্ষা মিশনের চেয়ারম্যান কার্তিক মান্না জানালেন, অশক্ত শরীর নিয়েও সিস্টার নিজে এই প্রকল্পের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেন তাঁদের কসবার দফতরে। শেখান, কী ভাবে দ্রুত এই পড়ুয়াদের নিজের-নিজের ক্লাসের উপযুক্ত করা যায়।

এই ২৫টি স্কুলের প্রতিটিতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে ৫ জন করে শিক্ষক নেওয়া হয়েছে, যাঁরা সকাল-বিকেল স্কুলের হোমে গিয়ে বাচ্চাদের হোমওয়ার্কে সাহায্য করেন। চলতি বছর হোমগুলি থেকে মোট ১৯ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। ১৭ জন ভাল ভাবে পাশ করেছে। যে দু’জন অকৃতকার্য হয়েছে, তারা মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল।

সিস্টারের নিজের কথায়, ‘‘বেছে ছেলেমেয়ে না-নিয়েও কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই পাশ করেছে। এর থেকেই প্রমাণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির একেবারে খোলনলচে বদলানো দরকার।’’ পুরনো ভুল শুধরে বাংলা মাধ্যম স্কুলে নতুন করে ইংরাজি শেখানোর পক্ষে তিনি।

এক সময় কলকাতা চষতেন স্কুটার চালিয়ে। অসুস্থতা বাড়লে এখন হুইল চেয়ার নিতে হয়। তাতে অবশ্য কাজের গতি থামেনি। কেঁপে যাওয়া গলাতেও আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। জানালেন, ফুটপাথের বাচ্চাগুলোকে একটু স্নান করিয়ে, পরিষ্কার জামা পরিয়ে, খাইয়ে, চুল আঁচড়ে বসিয়ে দিলে অন্যদের সঙ্গে কোনও তফাৎ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সম্পন্ন পরিবারের বাচ্চাদের থেকে তারা ব্যবহারে ভদ্র। দরকার শুধু একটু হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং সমাজের মানসিক ধ্যানধারণা বদলানো।

এতে যে সময় লাগবে, তিনি জানেন। রেনবো প্রকল্পে মানুষের আস্থা আনতে প্রায় তিরিশ বছর সময় লেগেছিল। সেই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় অনেক চড়াই-উতরাই রয়েছে। রাস্তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিজের সন্তানকে লেখাপড়া করাতে আপত্তিও তুলেছিলেন অনেকে। কিন্তু কোনও বাধাই টেঁকেনি।

চেয়ারে সামান্য ঝুঁকে বসে উজ্জ্বল চোখে সোজা তাকান সিস্টার। এক গাল হেসে বলেন, ‘‘শিক্ষার পাশাপাশি আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমি প্রতিষেধক ভরে দিয়েছি। আশপাশের কোনও রোগজীবাণু তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। তারা ঠিক এগিয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE