ব্যাটারিচালিত রিক্সা নিয়ে এক চালক। নিজস্ব চিত্র
‘বসেই দেখুন, বদলে গেছি’।
নাহ, তিন চাকার বাহনে এমন কিছু ‘টিজার’ লেখা নেই। কিন্তু বসলেই বদল টের পাচ্ছেন যাত্রীরা।
হাতে টানা রিকশা এখনও আছে। ঘাম ঝরিয়ে প্যাডেলে চাপ? তা-ও আছে। কিন্তু এ জিনিস আলাদা। যন্ত্রপাতি থেকে গান সবই বেশ টানটান।
শীতের বিকেলে এফএম ধরেছে, ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়...।’ চালক উদাস। অবহেলার অভিমানে নিভে গিয়েছে নীল সুতোর বিড়ি। সম্বিত ফেরে যাত্রীর হাঁকে, ‘ও দাদা, যাবেন তো?’
চালক টানটান। বিড়ি ফেলে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। আঙুলের চাপে গড়িয়ে চলে চাকা। লুকিং গ্লাসে যুগলকে দেখে চালক চাপ দিলেন আর একটি বোতামে।
মুহূর্তে গান-বদল! শুরু হল, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যে দিল কো...।’ এ বার তরুণীর কাঁধে মাথা রেখে সদ্য যুবকও বিড়বিড় করছেন, ‘কঁহি বদল না যানা সনম...।’ উপচে পড়া খুশি নিয়ে গান-রিকশা ছুটল সাতগাছি হয়ে শপিং মল।
‘হীরক রাজার দেশে’ থেকে এক্কেবারে ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’?
‘‘আজ্ঞে, অতশত বুঝি না। দু’টিকে দেখে মনে হল, একটা ইয়ে আছে। তাই মোবাইলে গানটা চালিয়ে দিলাম। যাত্রী খুশ। আমিও।’’ মুচকি হাসছেন অর্জুনপুরের সুব্রত সর্দার। তবে সকলেই যে খুশি হন, তা-ও নয়।
কখনও কখনও আবার সওয়ার বাবুর মেজাজ বুঝে গান বন্ধও করে দিতে হয়। আবার অলস দুপুরে ‘ইয়ে হ্যায় বোম্বে মেরি জান’ শুনে কেউ নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন, ‘‘আহা, কদ্দিন পরে গানটা শুনলাম হে!’’
রিকশা চালকেরা জানাচ্ছেন, ‘এ লাইনেও’ এখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। টোটো এবং অটোর সঙ্গে পাল্লা দিতে বাহনে বদল আনতে না পারলে হয়তো পথে বসতে হবে। পুরনো রিকশায় দু’জন যাত্রী উঠলে টানতে কষ্ট হত। ভাড়াও সেই এক। গতিতেও টোটো-অটোর সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছিল না।
ফলে কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে অনেকেই এই নতুন রিকশার দিকেই ঝুঁকছেন। অর্জুনপুর-গোরক্ষবাসী মোড়ে প্রায় ১৪০টি রিকশা চলে। এখন প্রায় ৪০টি রিকশা ব্যাটারিতে ছুটছে।
অর্জুনপুর বাজারে রিকশা তৈরির কারখানা বাপি দে-র। তিনি বলছেন, ‘‘বছর তিনেক ধরে এই রিকশার কদর বেড়েছে। খরচ চল্লিশ থেকে সত্তর হাজারের মধ্যে।’’
সাধারণ রিকশায় প্রবীণ কিংবা ছোটদের উঠতে সমস্যা হয়। এ রিকশায় মাটির কাছাকাছি রয়েছে পোক্ত পাদানি। দু’জন যাত্রীর সঙ্গে এক জন খুদে থাকলেও কুছ পরোয়া নেহি। চালকের ঠিক পিছনে খুদের জন্যও একটি আসন থাকছে। মাথার উপরে চওড়া ছাদ। ব্যাটারি ও যন্ত্রের সৌজন্যে গতিও বেড়েছে। একই ভাড়ায় উপরি পাওনা গান।
সে গানে যেমন আনন্দ আছে, বিড়ম্বনাও কম নেই। নাগেরবাজারের এক রিকশা চালক বলছিলেন, ‘‘বেশ রাতের দিকে চালক টলতে টলতে উঠে ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দো’ চালাতে বললেন। সে গান ছিল না। চালিয়ে দিলাম, ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে...’। আরিব্বাস, সে বাবুর কী গোঁসা!’’
‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমায় হাতকাটা কার্তিক ভুতোরিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিকশায় যেতে। ভুতোরিয়া আঁতকে উঠেছিল, ‘রিকশা করে যাব! রিস্ক হয়ে যাবে না?’ সদ্য যুবক রিকশা চালক হাসছেন, ‘‘তখন এ জিনিস বাজারে এলে পরিচালক ও ডায়ালগ রাখতেন না!’’
সুনসান রাতে বাড়ি ফিরছে ক্লান্ত রিকশা। ব্যাটারির চার্জ তলানিতে। সিটের নীচে রাখা মেয়ের জন্য কেনা খাতা, স্ত্রীর আবদারের শ্যাম্পুর স্যাশে। অক্লান্ত গলায় তখনও গেয়ে চলেছেন মান্না দে, ‘তুমি কি সেই আগের মতো আছ, নাকি অনেকখানি বদলে গেছ।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy