উতলা: আপনজনেদের চিন্তায় উদ্বিগ্ন মালয়ালিরা। নিজস্ব চিত্র
ভোর পাঁচটায় ফোনটা পাওয়ার পর থেকে আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি মহেশতলার বাসিন্দা সুপদ্রা মোহন। সরকারি আবাসনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখন তিনি হাউহাউ করে কাঁদছেন। ফোনের ও পারে সুপদ্রার মা আর বোনও চিৎকার করে কাঁদছেন। মেয়ের কাছে তাঁদের আর্তি, ‘‘আমাদের নিয়ে যা সুপদ্রা। জলে আমাদের ক্যাম্প ভেসে গিয়েছে। আর বাঁচব না!’’ এর পরে আর ঘুম হয়?
শুক্রবার নিজেদের আবাসনে দাঁড়িয়ে সুপদ্রা বলছিলেন, গত দু’দিন ধরেই কেরল থেকে ফোন আসছিল। কলকাতায় স্বামী আর ছেলের সঙ্গে থাকলেও তাঁর মন পড়ে রয়েছে কেরলেই। বাপের বাড়ি আলেপ্পি বন্যায় ডুবে গিয়েছে। বৃহস্পতিবারই সুপদ্রার মা সুমদি আর বোন বসুন্ধরাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্থানীয় একটি স্কুল-ক্যাম্পে। বৃহস্পতিবার রাতে সেই ক্যাম্পও ডুবে গিয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে একখণ্ড উঁচু জায়গা খুঁজছেন সুমদি আর বসুন্ধরা। বললেন, ‘‘নিজেদের বড় অসহায় মনে হচ্ছে। কী করা যায়, ভেবেই পাচ্ছি না।’’
অসহায় অবস্থা কেরলের বেশির ভাগ বাসিন্দারই। বন্যা পরিস্থিতি এমন আকার নিয়েছে যে মৃতের সংখ্যা দু’শো ছুঁইছুঁই। রাজধানী তিরুঅনন্তপুরম, কোল্লাম এবং কাসারগড়ের কিছু উঁচু এলাকা ছাড়া সবই প্রায় জলের তলায়। ওই রাজ্যে স্বজনদের কথা ভেবে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন এ শহরের মালয়ালিরাও। অবস্থা এমনই যে, আগামী ২৫ অগস্টের ওনাম উৎসব ইতিমধ্যেই বাতিল করে দিয়েছেন তাঁরা। নিজেদের জন্য নতুন পোশাক কেনার বদলে কেরলে আটকে পড়াদের জন্য ত্রাণ তুলছেন। বেহালার বাসিন্দা, স্কুলপড়ুয়া আকাশ রাজন তিন সপ্তাহ ধরে নাটকের পাঠ মুখস্ত করেছিল। কথা ছিল, ওনামে সেই নাটক মঞ্চস্থ হবে। পাঠ ভুলে এখন সে রোজ বিকেলে অর্থ সংগ্রহে বেরোচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে।
মালয়ালি সংগঠন ‘ক্যালকাটা কাইরালি সমাজম’ ট্রাস্টের প্রধান টি কে গোপালন বলছিলেন, অগস্টের সব উৎসবই শেষ করে দিয়েছে এই হঠাৎ বন্যা। জানালেন, আত্মীয়েরা তো বটেই, কেরলের বহু জেলায় বন্যার কবলে পড়েছে তাঁর বন্ধুদের পরিবার। গোপালনের কথায়, ‘‘পতনমতিড্ডায় তিন দিন ধরে আটকে রয়েছেন বন্ধুর মা-বাবা। একটা খাটে উঠে বসে রয়েছেন। বাকি সব ভেসে গিয়েছে। ওই খাটটাই সম্বল দুই বয়স্কের।’’ সেনা উদ্ধারকাজ শুরু করলেও এখনও ওই দম্পতির কাছে পৌঁছতে পারেনি। কবে সেনা তাঁদের নাগাল পাবে, তারও স্পষ্ট ধারণা নেই। বাবা-মায়ের চিন্তায় নাজেহাল ছেলে শ্রীকুমার বললেন, ‘‘ওঁদের বয়স হয়েছে। একা একা কী করছেন, বুঝতেই পারছি না। আমিই বা যাব কী করে? ঠিক কী করলে ওঁদের উদ্ধার করতে পারব জানি না।’’
বৃহস্পতিবার সকালেই হৃদ্রোগে মারা গিয়েছেন ত্রিশূরের বাসিন্দা, বর্তমানে কলকাতা নিবাসী ঊর্মিলা অজয়নের বাবা। ঊর্মিলা জানালেন, শেষ সময়ে চিকিৎসককেও দেখানো যায়নি। বন্যায় এমন পরিস্থিতি যে ঘরে শুয়েই মৃত্যু হয়েছে বৃদ্ধের। তাঁর কথায়, ‘‘জলের মধ্যেই আমাদের বা়ড়ির লোকজন বাবার দেহ নিয়ে বসে রয়েছেন। ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, বেরোনো যায়নি।’’
মাতৃভূমির এই মৃত্যুমিছিল প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছে মালয়ালি সঙ্গীতশিল্পী মনীষা মুরলী নায়ারকে। জীবনের বেশির ভাগ সময়টা শান্তিনিকেতনে কাটালেও কেরলের স্মৃতি একেবারে ফিকে হয়নি তাঁর। বললেন, ‘‘স্কুল ছুটির সময়ে তিরুঅনন্তপুরমে মামাবাড়ি যেতাম। ছেলেবেলার সেই এলাকা শুনলাম ঠিক আছে। কিন্তু, বাকিটা! সবই তো ভেসে গিয়েছে। এই মৃত্যুমিছিল যেন আর না বাড়ে।’’ একই প্রার্থনা ‘কলকাতা মালয়ালি অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক সুনীল নাম্বিয়ারও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy