Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Kolkata News

‘ভেবে নিন দূরে ঘুরতে পাঠাচ্ছেন’

রোগীর আত্মীয়দের বড় অংশ বলছেন, শুধু ওই কেন্দ্রেই নয়, রাজ্যের প্রায় সব নেশামুক্তি কেন্দ্রে রোগীর পরিবারের প্রবেশ নিষেধ। কেন্দ্রের ভিতরে কী ভাবে রোগীর চিকিৎসা হয়, তা নিয়ে সকলেই অন্ধকারে। অভিযোগ, এই গোপনীয়তার সুযোগে নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে চলে বেআইনি কাজ। চিকিৎসাধীন রোগীকে মারধরের পাশাপাশি, মালিকের বাড়ির কাজ করে দিতে বাধ্য করারও অভিযোগ ওঠে।

অন্দরমহল: এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে চলছে কাউন্সেলিং। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

অন্দরমহল: এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে চলছে কাউন্সেলিং। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

নীলোৎপল বিশ্বাস ও তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৮ ০২:১৩
Share: Save:

ঘরের দেওয়াল জুড়ে লেখা, ‘সদিচ্ছা থাকলে অন্ধকার কেটে বেরোনো শুধু সময়ের অপেক্ষা।’

সেই ঘরে অবশ্য আলোর দেখা নেই বললেই চলে। কোনও রকমে টিমটিম করে জ্বলছে একটা বাল্ব। টেবিলে সাঁটা নেশামুক্তি কেন্দ্রের একাধিক বিজ্ঞাপন। ভর সন্ধ্যায় সামনের চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তি!

ভিআইপি রোড সংলগ্ন একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের এই রিসেপশন পর্যন্তই যেতে পারেন রোগীর পরিজনেরা। কেন্দ্রের ভিতরের জগৎ সম্পর্কে তাঁরা অন্ধকারে। পরিবারের সদস্যকে ভর্তি করার সময়ে তো বটেই, তার পরেও নেশামুক্তি কেন্দ্রের অন্দরমহলে তাঁদের প্রবেশ নিষেধ। হাঁকডাক শুনে তন্দ্রাচ্ছন্ন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘আর ঢুকবেন না। এখানেই নাম লেখাতে হবে। ভিতরে যাওয়া নিষেধ।’’ রোগী কোথায় থাকবে দেখতে চাইলে তাঁর জবাব, ‘‘যাঁকে ভর্তি করাচ্ছেন, ভেবে নিন তাঁকে দূরে ঘুরতে পাঠাচ্ছেন। তাঁকে দেখা যাবে না।’’

রোগীর আত্মীয়দের বড় অংশ বলছেন, শুধু ওই কেন্দ্রেই নয়, রাজ্যের প্রায় সব নেশামুক্তি কেন্দ্রে রোগীর পরিবারের প্রবেশ নিষেধ। কেন্দ্রের ভিতরে কী ভাবে রোগীর চিকিৎসা হয়, তা নিয়ে সকলেই অন্ধকারে। অভিযোগ, এই গোপনীয়তার সুযোগে নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে চলে বেআইনি কাজ। চিকিৎসাধীন রোগীকে মারধরের পাশাপাশি, মালিকের বাড়ির কাজ করে দিতে বাধ্য করারও অভিযোগ ওঠে।

চলতি মাসের শুরুতেই চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তিকে মারধর করে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে সোনারপুরে একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। তার কয়েক দিনের মধ্যেই বেহালায় এক নেশামুক্তি কেন্দ্রে ওঠে চিকিৎসাধীন নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ। এই প্রেক্ষিতেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এক রোগীর আত্মীয় বলেন, ‘‘সরকারি কোনও ব্যবস্থাই নেই। মেয়েকে বাধ্য হয়ে একটি বেসরকারি নেশামুক্তি কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলাম। তিন মাস পরে গিয়ে দেখি, গায়ে ফোস্কা। জানতে চাইলে বলে, এখানে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় ওকে মারধর করা হয়েছে। আমি ছাড়িয়ে নিয়েছি।’’ আর এক অভিভাবকের অভিযোগ, ‘‘১৭ বছর বয়সের ছেলেকে সোনারপুরের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করিয়েছিলাম। সেখানে ওকে বিবস্ত্র করে মারধর করা হত। নেশা ছাড়ানোর নামে এই মারধর মেনে নিতে পারিনি। এখন তাই ছেলেকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করাচ্ছি।’’

শোভাবাজারের একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের মালিক টুকু পালের অবশ্য দাবি, তাঁদের সংস্থায় এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটে না। জানালেন, সংস্থায় ভর্তি করানোর পরে প্রথমে এক জন চিকিৎসক রোগীকে দেখেন। তার পরে দিন তিনেকের জন্য শুরু হয় ওষুধের কোর্স। এর পরের ধাপ কাউন্সেলিং। সেই সঙ্গে ধ্যান এবং শারীরচর্চা। রোগীর পরিজনকে বসিয়েও রোগীর সঙ্গে কাউন্সেলিং করানো হয় বলে দাবি টুকুর। কোর্স চলে ছ’মাস। কোর্সের খরচ, মাসিক ছ’হাজার টাকা। যদিও রোগীর পরিজনের অভিযোগ, কোনও নেশামুক্তি কেন্দ্রেই মনোবিদদের ডাকা হয় না। কাউন্সেলিং করান সংস্থার কর্মীরাই, যাঁদের কার্যত কোনও প্রশিক্ষণই নেই। মালিকদেরও অবশ্য যুক্তি থাকে। অনেকেরই দাবি, মনোবিদের থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতাই রোগীকে বেশি অনুপ্রাণিত করে। কামালগাজির একটি নেশামুক্তি কেন্দ্রের মালিক তন্ময় বসু বলেন, ‘‘আমি নিজে নেশাগ্রস্ত ছিলাম। পরে সংস্থা গড়েছি। ফলে আমাদের মতো অভিজ্ঞতা চিকিৎসকদেরও নেই। সরকারও আমাদের মতো লোক রাখতে পারে না বলে নেশামুক্তি কেন্দ্র করতে পারে না।’’

বছর পনেরো ধরে নেশামুক্তির কাজে যুক্ত বিদিশা ঘোষ বিশ্বাস জানাচ্ছেন, মারধর কিংবা শাস্তি দিলে সুফল পাওয়া মুশকিল। আইনের চোখেও তা শাস্তিযোগ্য। কোনও মানসিক রোগীকে মারধর অনৈতিক এবং বেআইনি। তাঁর কথায়, ‘‘নেশামুক্তির কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে গেলে সহিষ্ণুতা জরুরি। নেশামুক্তির সময়ে আসক্তদের শরীরে নানা প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে তাঁরা অন্য রকম আচরণ করেন। নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মীদের সেই আচরণ ধৈর্যের সঙ্গে সামলাতে শিখতেই হবে।’’ শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

লালবাজার সূত্রের খবর, সোনারপুর এবং বেহালার সাম্প্রতিক ঘটনার পরে একাধিক নেশামুক্তি কেন্দ্রে অভিযান চালানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও বহু এলাকায় বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন নেশামুক্তি কেন্দ্র রমরমিয়ে চলছে বলে জানাচ্ছেন পুলিশ আধিকারিকেরাই। এই ধরনের চিকিৎসা কেন্দ্র খোলার জন্য কোন কোন দফতর থেকে কী ধরনের অনুমতি নিতে হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি পুলিশও। ভিআইপি রোডের ওই সংস্থার মালিকের দাবি, ‘সোসাইটি অ্যাক্ট ১৯৬১’-এ অনুমতি নিয়েছেন তাঁরা। সেই অনুমতিই কি যথার্থ? সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের নেশামুক্তি কেন্দ্রের অনুমতি দেন না তাঁরা।

তা হলে সংস্থা চলছে কী ভাবে? উত্তর জানেন না কেউই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE