Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
দুই তাণ্ডব, এক প্রশ্ন: পুলিশ কার জন্য

মাঝরাতে মাইক থামাতে বলে আক্রান্ত শিল্পী দম্পতি

গভীর রাত। সরস্বতী পুজোর ভাসান ঘিরে চলছে তারস্বরে ‘ডি জে’ গান। সেই শব্দের তাণ্ডবে বাড়ির ভিতরে ছটফট করছেন অসুস্থ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এক সময়ে এই অত্যাচার আর মানতে না পেরে প্রতিবাদ করেন বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের ছেলে অয়ন ঘোষ। অভিযোগ, এর পরেই তাঁদের দিকে পরপর ধেয়ে আসে ইটের টুকরো। তার আঘাতে ভেঙে যায় বাড়ির জানলার কাচও। সাহায্য চেয়ে রাতেই ফোন করা হয় পুলিশকে। এক বার নয়, বেশ কয়েক বার।

আতঙ্কের রেশ কাটেনি তখনও। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষ। পাশে তাঁদের ছেলে অয়ন।

আতঙ্কের রেশ কাটেনি তখনও। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষ। পাশে তাঁদের ছেলে অয়ন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৪২
Share: Save:

গভীর রাত। সরস্বতী পুজোর ভাসান ঘিরে চলছে তারস্বরে ‘ডি জে’ গান। সেই শব্দের তাণ্ডবে বাড়ির ভিতরে ছটফট করছেন অসুস্থ দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।

এক সময়ে এই অত্যাচার আর মানতে না পেরে প্রতিবাদ করেন বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের ছেলে অয়ন ঘোষ। অভিযোগ, এর পরেই তাঁদের দিকে পরপর ধেয়ে আসে ইটের টুকরো। তার আঘাতে ভেঙে যায় বাড়ির জানলার কাচও। সাহায্য চেয়ে রাতেই ফোন করা হয় পুলিশকে। এক বার নয়, বেশ কয়েক বার। কিন্তু অভিযোগ, সারা রাত পুলিশের কোনও উপস্থিতি টের পাওয়া যায়নি। পুলিশি তৎপরতা শুরু হয় পরদিন সকালে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে। ততক্ষণে স্থানীয় বিধায়ক ব্রাত্য বসুরও ফোন চলে গিয়েছে থানায়। বুধবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে দমদম এলাকায়। ঘটনার কথা জানাজানি হতে আতঙ্ক ছড়িয়ে এলাকা জুড়ে। প্রশ্ন উঠেছে আইন-শৃঙ্খলা ও এলাকাবাসীদের নিরাপত্তা নিয়েও।

পরে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান অজয় ঠাকুর জানান, এই ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও খোঁজ চলছে। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম রবীন সিংহ, পঙ্কজ সিংহ ও অধেশ সাউ। এদের বাড়ি ওই এলাকারই মন্দির রোডে। অজয়বাবুর বক্তব্য, “পুলিশের গাফিলতির অভিযোগও মিলেছে। সে নিয়েও তদন্ত হবে। প্রয়োজনে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের কর্তাদের এই আশ্বাস এলাকাবাসীদের মনে কার্যত কোনও ভরসাই জোগাচ্ছে না। এমনই জানাচ্ছেন স্থানীয় বহু মানুষ।

তিন অভিযুক্তের গ্রেফতারের পরেও আতঙ্ক কাটেনি পার্থবাবুর। তিনি বলেন, “শব্দ-তাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুটল ইট-বৃষ্টি। এ যাত্রায় হয়তো বেঁচে গেলাম। কিন্তু পরে যে ফের কিছু অঘটন ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে রাস্তায় যে আমাদের কেউ আক্রমণ করবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?”

দমদমের বরফকল এলাকার ডক্টর এস পি মুখার্জি রোডের একটি বহুতলের দোতলায় থাকেন পার্থবাবুরা। পার্থবাবুর বয়স ৭৫ এবং গৌরীদেবীর ৭৪। সঙ্গে থাকেন তাঁদের ছেলে অয়ন। দমদম থানা থেকে আক্ষরিক অর্থেই ঢিল ছোড়া দূরত্বে এই ফ্ল্যাট বাড়িটি। পুকুরপাড়ে পাড়ার ছেলেরা মিলে সরস্বতী পুজো করেছিল আর পাঁচটা পাড়ার মতোই। কিন্তু অভিযোগ, গত চার দিন ধরেই সেখানে চলছিল মাইকের তাণ্ডব। শুধু পার্থবাবুরাই নন, তাঁদের প্রতিবেশীরাও জানালেন, এই তাণ্ডবে কতটা বিরক্ত হচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু নানা ভাবে প্রতিবাদ করেও ফল হয়নি। ওই ফ্ল্যাটেরই তিনতলার বাসিন্দা রাজকুমারী শ্রীবাস্তব বলেন, “গত বছর শব্দের দাপট থেকে বাঁচতে দমদম থানায় অভিযোগ করেছিলাম। পাড়ার ছেলেরা সে কথা জানতে পেরে আমায় হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল। আমার গাড়ির চালককে মারধর করেছিল।”

এ বারও চার দিন ধরে গানের নামে চলেছে তাণ্ডব। এলাকারই আর এক বাসিন্দা রিনা দাস বলেন, “ওরা যখন ভোগ দিতে আসে, আমি তা নিইনি। বলেছি, চার দিন ধরে আমার ছেলে-মেয়েরা তোদের মাইকের আওয়াজে পড়তে পারছে না। আগে মাইক থামা, তার পরে ভোগ খাব।” তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ নিয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করেননি। কিন্তু শব্দ-তাণ্ডবের প্রতিবাদ করলে কপালে যে ইট-বৃষ্টি জুটবে, এমনটাও কেউ ভাবতে পারেননি।

অয়ন জানালেন, বাইরে থেকে ইট ছুড়েই শেষ হয়নি তাণ্ডব। উপরে উঠে তাঁদের দরজায় লাথিও মারা হয়েছে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়লে যে কী হত, ভাবলেই আতঙ্ক লাগছে। এলাকাবাসীরাই জানাচ্ছেন, এটি কোনও ক্লাবের সরস্বতী পুজো নয়। পুজো করেছে পাড়ারই ছেলেরা। এদের বেশির ভাগের বয়সই ১৭ থেকে ২০-র মধ্যে। কিন্তু পাড়ার কয়েক জন কিশোর ও সদ্য তরুণ এই তাণ্ডব চালানোর সাহস পেল কী করে, এখন প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।

স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, ওই কিশোর-তরুণেরা মোটেই হামলা চালায়নি। ভাসানে যোগ দিয়েছিল পাশের মন্দির রোডের কিছু ছেলে। অভিযোগ, তারাই এমন করেছে। অয়নও বলেন, “যে লম্বা চুলের ছেলেটা ইট হাতে আমাদের রেলিং বেয়ে উপরে উঠে এসেছিল, সে পাশের পাড়ায় থাকে। ওর মুখ চেনা। হোটেলে বাউন্সারের কাজ করে।”

তিন জন গ্রেফতার হলেও অভিযোগ, মূল অভিযুক্তেরা এখনও অধরাই। অয়ন বলেন, “ঘটনার সময়ে বেশ কয়েক বার দমদম থানায় ফোন করেছি। থানা থেকে বারবার বলেছে, সাদা পোশাকের পুলিশ পাঠিয়েছে। কিন্তু কোথায় পুলিশ? ওরা তো তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়ে গেল।” শেষে এক বার পুলিশের জিপ টহল দিয়ে যায়। কিন্তু জিপ চলে যেতেই ফের দ্বিগুণ উৎসাহে তাণ্ডব শুরু হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের জিপ কেন তখন ঘটনাস্থলে থেকে গেল না? মূল অভিযুক্তেরা তো তখনই গ্রেফতার হয়ে যেত। প্রশ্ন তুলছেন অয়ন। ওই আবাসনের আর এক বাসিন্দা প্রণব দাস বলেন, “পুলিশ তো দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইট ছোড়া দেখেছে। সারা রাত পুলিশ না আসায় আমরা আতঙ্কে কেঁপেছি।”

দমদম থানা অবশ্য পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করেছে এই ‘অবহেলার’ জন্য। দমদম থানার এক পুলিশ অফিসারের দাবি, বুধবার রাতে ভাসান নিয়ে বিভিন্ন পাড়া থেকে বেশ কয়েকটা অভিযোগ আসছিল। সেগুলি দেখতে দু’টো জিপ চলে গিয়েছিল। পরে পার্থবাবুরা যখন ফোন করে অভিযোগ করেন, তখন আর থানায় জিপ ছিল না। থানায় জিপ আসতেই সেটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক বার যখন পুলিশের জিপ টহল দিতে এল, তখন ঘটনাস্থলে কেন পুলিশ থেকে গেল না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।

স্থানীয়দের একাংশ এবং বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, শাসক দলের প্রশ্রয় না থাকলে এত সাহস পেত না ওই যুবকেরা। বস্তুত, যে এলাকার যুবকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই পাড়াতেই দমদম পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ও তৃণমূল নেতা হরিদেব সিংহের বাড়ি। হরিদেববাবু এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “খবর পেয়েই পার্থবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। কারা এই হামলা করেছে, সে বিষয়ে আমিও খোঁজখবর নিচ্ছি।”

ঘটনাটি জানাজানি হতেই স্থানীয় বিধায়ক ব্রাত্য বসু বেশ কয়েক বার ফোন করেন পার্থবাবুদের। এমনকী, সকাল গড়াতে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের উচ্চপদস্থ কর্তাদের দেখা যায় পার্থবাবুদের বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করতে। ব্রাত্যবাবু বলেন, “দোষী যারাই হোক না কেন, পুলিশ যেন কড়া পদক্ষেপ করে এবং অভিযুক্তেরা দ্রুত গ্রেফতার হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে বলেছি। এমনকী, কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলেও যেন তাদের রেয়াত না করা হয়, সেই ব্যাপারেও পুলিশকে বলেছি। ঘটনাস্থলে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তাদারেও যেতে অনুরোধ করেছি।”

এ দিকে, সকাল থেকে তিন যুবক গ্রেফতার হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা এলাকায়। পুলিশ জানায়, ওই পুজোর সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগ যুবকই আপাতত ঘরছাড়া।

—নিজস্ব চিত্র

দুই তাণ্ডব, এক প্রশ্ন: পুলিশ কার জন্য

শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে প্রহৃত কোমায়, কাঠগড়ায় তৃণমূল

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gauri ghosh parta ghosh attack fear
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE