জতুগৃহ: মার্কেন্টাইল বিল্ডিংয়ের মিটার বক্স। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
বিপজ্জনক পড়শি নিয়েই দিন কাটছে কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের!
আট বছর আগের প্রশাসনিক কড়া নির্দেশিকা, দমকলের বিপদ-আশঙ্কা, পুর-কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা সত্ত্বেও বিপজ্জনক ভাবেই এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে লালবাজারের ঠিক উল্টো দিকের শতাব্দীপ্রাচীন মার্কেন্টাইল বিল্ডিং। প্রাণ হাতে ওই বাড়িতেই দিন কাটছে অন্তত ৫০০ ব্যবসায়ীর। গত শনিবার বাগড়ি মার্কেট বিপর্যয়ের পরে এই বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চাপানউতোর শুরু হয়েছে।
২০১০ সালের মার্চে স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডের পরে শহরের আরও ১১টি বহুতলের পাশাপাশি মার্কেন্টাইল বিল্ডিংকেও বিপজ্জনক ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন স্পেশ্যাল কমিশনার বাণীব্রত বসুর নেতৃত্বে বিশেষ প্রতিনিধি দল মার্কেন্টাইল বিল্ডিং পরিদর্শন করে অবাক হয়ে যান। পেল্লায় বহুতলে কোনও অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাই ছিল না! বাড়িটিকে একেবারে ‘পঙ্গু’ ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। বাড়িটির বেশ কিছু বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছিল প্রতিনিধি দল। সেই কাজ অবশ্য কিছুই হয়নি। অথচ, এই বহুতলের ঠিক বিপরীতে কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের পাশাপাশি ঢিল ছোড়া দূরত্বে রয়েছে মহাকরণও। ১০০ মিটারের মধ্যেই দমকলকেন্দ্র!
মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল, ছ’তলা ভবনটির মোট পাঁচটি ব্লক রয়েছে। কয়েক জন দারোয়ান সপরিবারে থাকেন। এ ছাড়া বাকি ভবন ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হয়। ব্লক পিছু তো দূরের কথা, পেল্লায় ভবনে সিঁড়ি মাত্র তিনটি। সেগুলির অবস্থাও ভয়ঙ্কর। চুন খসে ইটের পাঁজর বেরিয়ে এসেছে। সিঁড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে একের পর এক তারের জট। কোনও মতে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের তার এক ব্লক থেকে অন্য ব্লকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এক একটি ব্লকের মধ্যে রয়েছে সংযোগ রক্ষাকারী বারান্দা। সেগুলির অবস্থা এমনই যে কবে ভেঙে পড়বে কেউই জানেন না। বারান্দার ধারের রেলিংয়ে হাত রাখলেই বিপজ্জনক ভাবে নড়ে ওঠে। বিল্ডিংয়ের একাংশে বেশ কিছু গুদাম ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলির কোনও পুর-অনুমতি রয়েছে কি না, জানাতে পারলেন না ব্যবসায়ীরা।
রমেশ পাণ্ডে নামে এক ব্যবসায়ীর আক্ষেপ, ‘‘কোনও মতে আমরা আছি। পুলিশ এসে বলে গিয়েছিল। কোনও কাজ হয়নি। অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাই নেই এখানে। পুড়েও মরতে পারি আবার বাড়ি ভেঙে চাপা পড়েও মৃত্যু হতে পারে।’’ ‘মার্কেন্টাইল বিল্ডিং টেন্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক রাজেন্দ্রকুমার ব্যাস অবশ্য ভবনের ভগ্নদশার দায় মালিক গোপাল স্নেয়ির উপরে চাপালেন। তাঁর দাবি, ‘‘বাড়িওয়ালা সমঝোতায় আসতে চান না। লিফট বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন। জলও বন্ধ। বিপদ ঘটল বলে!’’ গোপালবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘প্রশাসনের নির্দেশ মেনে যতটা পেরেছি নিজের খরচে করেছি। ভাড়াটেদের কেউ সাহায্য করেননি।’’ একে অপরের উপরে দোষ চাপিয়েই আপাতত দায় এড়াতে চাইছেন সকলে।’’
আরও পড়ুন: ক্ষতিগ্রস্ত ওষুধ বিক্রি রুখল ড্রাগ কন্ট্রোল
একই রোগে আক্রান্ত চাঁদনি চকের ১ নম্বর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটের বাড়িটি। ২০১০ সালের মার্চে এই বাড়ির অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়েছিল স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডের স্মৃতি। বাড়িটিতে আটকে পড়েছিলেন চারতলার এক বাসিন্দা। স্টিফেন কোর্টের মতো এই বাড়ির ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির দরজাও বন্ধ ছিল সে দিন। আশঙ্কা করা হয়েছিল, স্টিফেন কোর্টে সিঁড়িতে পুড়ে মৃত ১৭ জনের মতোই পরিণতি হতে পারত ওই বাসিন্দার। পরে বিশেষ
প্রতিনিধি দলের সদস্যেরা গিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটের বাড়িটিকে ‘ভয়ঙ্কর’ ঘোষণা করেন। আট বছর পরেও গিয়ে দেখা গেল বাড়ির বিপদ-চিত্রে কোনও বদল হয়নি।
আরও পড়ুন: একাধিক অভিযোগ থাকলেও বাগড়িদের নিয়ে ‘উদাসীন’ পুলিশও!
প্রবেশপথ এতটাই সঙ্কীর্ণ যে ঢুকতে গেলে হোঁচট খাওয়া নিশ্চিত। নোনা ধরা দেওয়াল জু়ড়ে তারের জট দেখে গাছের ঝুরি বলে ভ্রম হতে পারে। ‘বিপজ্জনক’ বলে বাড়ির বেশ কিছু বারান্দা ইতিমধ্যেই ব্যবহার করা ছে়ড়েছেন ভাড়াটেরা। তার মধ্যেই যেখানে সেখানে ঝুলছে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের তার। সেখানেই ব্যবসার কাজে ব্যস্ত এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘কিছু লাভ হবে না। এ বা়ড়ির কোনও সংগঠন নেই। মালিকও আমাদের কথা শোনেন না। কার কাছে যাব!’’
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানালেন, পুরনো বাড়িগুলির এই অবস্থা নিয়ে তিনি চিন্তিত। বললেন, ‘‘দ্রুত ব্যবস্থা নেব। সব দিক থেকে ব্যাপারটা দেখতে হবে।’’ তবে সুরাহা মিলতে আরও কত দিন? উত্তর নেই মেয়রের কাছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy