অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকে দাম নিচ্ছে পাড়ার মুদি দোকান। কার্ড সোয়াইপ মেশিন বসানোর দাবি আসছে মাছের খুচরো ক্রেতার থেকে! বৈধ নোটের আকাল কলকাতার বাজারে কী প্রভাব ফেলেছে, মঙ্গলবারের এ সব খণ্ডচিত্র তারই প্রমাণ। সঙ্গে এটাও পরিষ্কার, অচল পাঁচশো-হাজারের নোটে লেনদেন ক্রমেই আরও কমছে।
দমদমের গোরাবাজারের এক মুদির দোকানির হাতে সাত-আটটি চেক। তাঁর কথায়, ‘‘কী করব? এত বছরের পুরনো সব খদ্দের। ফেরাতে তো পারি না! সেই বিশ্বাস আমার আছে যে, ওঁদের দেওয়া চেক বাউন্স করবে না। অচল পাঁচশো-হাজারের নোট নিজের অ্যাকাউন্টে আর কত দেব?’’
রোজ হাজার বিশেক টাকার ব্যবসা করেন দক্ষিণ কলকাতার এক মাছ বিক্রেতা। তাঁকে শুনতে হচ্ছে— ‘‘এ বার কার্ড সোয়াইপ মেশিন বসান।’’ ব্যবসায়ীর বক্তব্য, ভেজা হাতে ওই মেশিন ধরা যায় না। তা হলে অন্য লোক রাখতে হবে। তৎক্ষণাৎ আর এক ক্রেতার মন্তব্য, ‘‘তা হলে পাঁচশো-হাজারের নোট নিচ্ছেন কেন? কিছু জায়গা ছাড়া ওই টাকায় লেনদেন তো বেআইনি।’’ এর পরে ওই বিক্রেতা অচল নোট নিচ্ছেন লুকিয়ে। বলছেন, ‘‘আমার কাছে ১০০-র নোট বেশ কিছু রাখা আছে। আমার ও বাড়ির লোকেদের তিন-চারটে সেভিংস অ্যাকাউন্টও আছে। তাই নিতে পারছি।’’ সেই সঙ্গেই অবশ্য জানাচ্ছেন, ‘‘৩০ নভেম্বরের পরে আমি আর পাঁচশো-হাজারের নোট নিতে পারব না।’’ এর মধ্যেই এ দিন বালি বাজারে বিক্রেতারা ১০ টাকার কয়েন দিলে নিতে চাননি অধিকাংশ ক্রেতাই। তার জেরে বচসা। শেষমেশ বিক্রেতারা ব্যাঙ্কে জানালে তারা নোটিস সেঁটে জানিয়ে দেয়, ১০ টাকার কয়েন বৈধ।
এই পরিস্থিতিতে কৌশলও তাই এক-এক রকম। যাদবপুর সুপার মার্কেটের মুদি দোকানি ননীগোপাল শীটের যেমন শর্ত— পাঁচশোর পুরনো নোট অবশ্যই নেবেন, তবে চারশো টাকার জিনিস কিনতে হবে! যাদবপুরের মাছ ব্যবসায়ী সুব্রত দাসের কাছে হাজার টাকার নোট নিয়ে গিয়েছিলেন পুরনো খদ্দের। ঠেলাঠেলি করে মোট আটশো টাকার মাছ গছিয়ে তবেই হাজারের অচল নোট নিলেন সুব্রত! সুপার মার্কেটেরই চাল বিক্রেতা রানা পালের কথায়, ‘‘গত দু’দিনে অচল নোট নিইনি। তাতে ব্যবসা লাটে ওঠার জোগাড়। মঙ্গলবার থেকে বাধ্য হয়ে নিচ্ছি। এক দিন ব্যাঙ্কে চার ঘণ্টা লাইন দিয়ে দশ হাজার টাকা তুলেছিলাম। পুরোটা একশোর নোটে। পুরনো নোট নিয়ে তাই খুচরো দিতে পারছি। কিন্তু ক’দিন এমন চলবে?’’
রবিবারই শহরের বিভিন্ন বাজার মিলিয়ে গড়ে অন্তত ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল সব্জি-মাছ-মাংসের বিক্রি। মঙ্গলবার সেই হ্রাস কোথাও ৩০, কোথাও বা ৪০ শতাংশ। কোনও কোনও বিক্রেতা যা মাছ তুলেছিলেন, সেটুকু কম দামে বেচে হাত ফাঁকা করার চেষ্টা করছেন। লক্ষ্য একটাই— লাভ না হোক, লোকসান যাতে না হয়। সল্টলেকের ফাল্গুনি বাজারে দু’কেজির বেশি ওজনের জ্যান্ত কাতলা ২৩০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সাধারণত যা ২৮০ টাকা। একই ওজনের জ্যান্ত গোটা রুই ২৫০ টাকার বদলে বিকিয়েছে ১৮০-২০০ টাকায়।
বাঘা যতীন বাজারে গত সপ্তাহে মাঝারি সাইজের পমফ্রেট কেজি প্রতি ছিল সাড়ে পাঁচশো টাকা। এ দিন তেমনই মাছ চারশো টাকা! বাজারে খদ্দের এতই কম যে, চোখে লাগছে। কিছু বিক্রেতা হাঁকছেন ‘‘আসুন আসুন, দাম কম!’’। বিদ্যাসাগর উপনিবেশের বাসিন্দা লাল্টু সরকার মঙ্গলবার দুটো ফুলকপি কিনেছেন ৩০ টাকায়। আর সব্জি বিক্রেতাকে হাসিমুখে বলেছেন, ‘‘নোটের চক্করে দাম কমিয়ে দিলে! পাঁচ দিন আগেও তো এই একই জোড়া ৪৫ টাকা নিয়েছ। ৪০-এও দাওনি!’’
মানিকতলা বাজারের সব্জি বিক্রেতা শৈলেন রায়ের কথায়, ‘‘সব সব্জিরই দাম কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা কমাতে বাধ্য হয়েছি। তবু তেমন বিক্রি নেই।’’ আর এক বিক্রেতা মহম্মদ ইরফান বলেন, ‘‘সব্জি প্রায় রোজই বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু নোট সমস্যায় লোকে সব্জি কেনা এ ভাবে কমাবে, ভাবতে পারিনি।’’ কোলে মার্কেটের পাইকার, হুগলির কামারকুণ্ডুর সুদীপ বৈরাগী বলেন, ‘‘এক পাল্লা বা পাঁচ কেজি গাজর অন্যান্য বছর এ সময়ে ২৮০ টাকায় বেচেছি। এখন ২৪০ টাকাতেও তেমন কেউ নিচ্ছে না।’’
১৫ বছর ধরে কোলে মার্কেট থেকে সব্জি নিতে আসা মানিকতলা বাজারের খুচরো বিক্রেতা রাজু পাত্র পাঁচশো, হাজারের নোট এনেছিলেন। কয়েক জন পাইকার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এ সব নোট অচল তো জানতেন, তবু আনলেন কেন?’’ রাজুর কাতর উক্তি, ‘‘দাদা, ব্যাঙ্কে গিয়ে ছ’ঘণ্টা লাইন দিলে ব্যবসা লাটে উঠবে।’’ অনুরোধে অবশ্য কাজ হয়নি। এ দিন সব্জি পাননি রাজু। পনেরো বছরে এ-ই প্রথম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy