Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিপদ বাড়াচ্ছে ‘উড়ন্ত’ রিকশা, রাশ টানার ভাবনা

পাতিপুকুর থেকে রেললাইন বরাবর রাস্তা ধরে দমদম স্টেশনে যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। উঠে বসার পরেই তাঁরা আবিষ্কার করলেন, উল্কার গতিতে দৌড়চ্ছে মোটরচালিত যানটি। আর পা তুলে খোশমেজাজে বসে রয়েছেন রিকশাচালক। ভয়ে তাঁরা আস্তে চালাতে বলেন।

সল্টলেকে চলছে মোটরচালিত এই রিকশা। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

সল্টলেকে চলছে মোটরচালিত এই রিকশা। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৭:৪৪
Share: Save:

পাতিপুকুর থেকে রেললাইন বরাবর রাস্তা ধরে দমদম স্টেশনে যাচ্ছিলেন এক দম্পতি। উঠে বসার পরেই তাঁরা আবিষ্কার করলেন, উল্কার গতিতে দৌড়চ্ছে মোটরচালিত যানটি। আর পা তুলে খোশমেজাজে বসে রয়েছেন রিকশাচালক। ভয়ে তাঁরা আস্তে চালাতে বলেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! নিয়ন্ত্রণ হারানো রিকশাটি সোজা গিয়ে সেঁধিয়ে যায় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি টোটোর মধ্যে। ছিটকে পড়ে কোমরের হাড় ভাঙে স্ত্রীর। স্বামীর হাতেও চোট লাগে। ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘রিকশাওয়ালাকে কিছু বলব কী! দেখি তাঁরও সামনের দাঁত পড়ে গিয়েছে! ঠোঁট ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে।’’

প্রথমে ছিল হাতে টানা রিকশা। কষ্ট কমাতে তার পরে আসে প্যাডেলের রিকশা। কায়িক শ্রম আরও লাঘব করতে এ বার রিকশায় বসেছে মোটর। অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিতে যেন প্রায় উড়তে শুরু করছে মোটরচালিত সেই রিকশা। আর সেখান থেকেই বিপত্তির শুরু। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় এখন জাঁকিয়ে বসেছে মোটর-রিকশা। সওয়ারি নিয়ে প্রায় রথের গতিতে উড়ে চলছে। কিন্তু পলকা লোহা আর কাঠের তৈরি রিকশা কি আর গাড়ির মতো ভারী হয়? ফলে বেগ বাড়লেও ভর না থাকায় বেসামাল করে দিচ্ছে ভরবেগ। এবং হুড়মুড়িয়ে রিকশা উল্টে সওয়ারি সোজা মাটিতে! হাড়গোড় ভাঙাও আশচর্যের নয়।

পাতিপুকুর, কেষ্টপুর, দমদম, লেকটাউন, এমনকী সল্টলেকের মতো জায়গাতেও দেদার চলছে এমন যন্ত্রচালিত রিকশা। ছোটখাটো অলিগলিতে ঢুকে পড়ছে হু হু করে। বাঁক নিতে গিয়ে ঘটছে বিপত্তি। এক গাড়িচালকের কথায়, ‘‘বাঁক ঘোরার সময়ে সামনে রিকশা দেখে সেই হিসেবমতো গতিতে কাটাতে গিয়ে দেখি, এ তো আকারে রিকশা হলেও আমার চেয়েও বেশি গতিতে রয়েছে। ফলে আন্দাজ করতে করতেই ধাক্কা লেগে যাচ্ছে।’’ এ ভাবেই নিত্য দুর্ঘটনা লেগে রয়েছে যন্ত্রচালিত রিকশাগুলিতে।

বস্তুত, এই ব্যবস্থার প্রথমে আত্মপ্রকাশ নদীতে। সেকালের দাঁড়-পালের নৌকায় মোটর লাগিয়ে তৈরি হয় যন্ত্রচালিত ভটভটি। নৌকায় মোটর লাগানোর জন্য দেদার চুরিও হতে থাকে মোটরবাইক। এর পরেই শহরতলি, মফস্সল এবং গ্রামে-গ্রামে পায়ে টানা ভ্যান রিকশায় মোটর লাগানোর চল শুরু হয়। ভ্যানরিকশার নাম পাল্টে হয়ে যায় ভ্যানো। এর পরেই মোটর এসেছে রিকশায়।

এমনিতে প্যাডেল রিকশা কিনতে খরচ পড়ে ১২ হাজার টাকার মতো। সেখানে মোটর-রিকশার দাম প্রায় ৫৫ হাজার টাকা। হাতে অ্যাক্সিলরেটর, পায়ে ব্রেক। অনেকটা মোটরবাইকের মতো, তবে গিয়ার নেই। অনেকটা স্কুটির মতো এই যানে গতি কমবেশি নিয়ন্ত্রিত হয় কেবলমাত্র অ্যাক্সিলেটরেই। আর সমস্যাটাও সেখানেই। কারণ, গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দমদম স্টেশনের এক রিকশাচালকের কথায়, ‘‘এমনিতেই পায়ে টানা রিকশা ডাইনে-বাঁয়ে কাটে। জোরে চালিয়ে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এক পাশে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তার পরে মোটর বসলে তো কথাই নেই।’’

মোটর-রিকশায় থাকে ব্যাটারিও। এক বছর মেয়াদের সেই ব্যাটারি চার্জ করে চালাতে হয়। ব্যাটারি পাল্টানোর খরচ ২০ হাজার টাকার মতো। সিঁথির মোড়ের এক রিকশাচালকের কথায়, ‘‘বৃষ্টিতে এই রিকশা নিয়ে বেরোনো যায় না। মোটর, ব্যাটারির ক্ষতি হয়।’’ এত সমস্যা সত্ত্বেও মোটর-রিকশা বাড়ছে কেন? লেকটাউনের এক চালকের কথায়, ‘‘কষ্ট একটু কম হচ্ছে। আর মোটরে চললে বোধহয় একটু স্ট্যাটাসও বাড়ে।’’

কারণ যা-ই হোক, এ সবের জন্যই বাড়ছে দুর্ঘটনা। গত কয়েক বছরে ভ্যানো-দুর্ঘটনায় রাজ্যে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। মোটর-চালিত রিকশার ক্ষেত্রে এখনও মৃত্যুর খবর না এলেও দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে!

কিন্তু এমন রিকশা কেবল বেআইনি শুধু নয়, পুরসভার পক্ষ থেকে তাদের লাইসেন্স দেওয়ারও কোনও বিধি নেই। তা হলে কী ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটর-রিকশা।

যে এলাকায় সবচেয়ে বেশি দেখা মিলছে মোটর-রিকশার, সেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিবহণ দফতরের সদস্য গোপাল শেঠ বলেন, ‘‘মোটর-রিকশা, ভ্যানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে হাইকোর্ট। সরকারি তরফেও বারণ করা হয়েছে। কোনও জায়গায় যাতে এগুলি চলতে না পারে, সে জন্য একটি কমিটিও তৈরি করা হয়েছে। সেই কমিটিই এখন বেআইনি এই রিকশাগুলি আটক করবে।’’

কিন্তু রিকশা কেড়ে নিলে চালকদের চলবে কী করে? গোপালবাবু বলেন, ‘‘যারা ওই বেআইনি গাড়ি ছেড়ে পায়ে টানা রিকশা নেবেন, তাঁদের পরিবহণ দফতরই তাদের সহযোগিতা করবে।’’

এত কিছুর পরে কি বন্ধ হবে মোটর রিকশা? সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flying rickshaw
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE