Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বালি

চটকলের ভোটে তৃণমূলের গৃহযুদ্ধ রুখতে পথে র‌্যাফ

শাসকদলেরই বিভিন্ন নেতা। আর তাঁদের সমর্থনে ভোটে লড়ছেন মোট ১৩ জন। সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিপিএমের আরও পাঁচ প্রার্থী। এঁদের সামাল দিতেই এলাকায় ১৪৪ ধারা। রাস্তায় টহল দিচ্ছে র‌্যাফ। মোতায়েন বিশাল পুলিশ বাহিনী।

কড়া প্রহরায় চলছে ভোট। শুক্রবার, বালিতে। —নিজস্ব চিত্র।

কড়া প্রহরায় চলছে ভোট। শুক্রবার, বালিতে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:২৩
Share: Save:

শাসকদলেরই বিভিন্ন নেতা। আর তাঁদের সমর্থনে ভোটে লড়ছেন মোট ১৩ জন। সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিপিএমের আরও পাঁচ প্রার্থী। এঁদের সামাল দিতেই এলাকায় ১৪৪ ধারা। রাস্তায় টহল দিচ্ছে র‌্যাফ। মোতায়েন বিশাল পুলিশ বাহিনী। এখানেই শেষ নয়, ভোট কেন্দ্রে শান্তি বজায় রাখতে সর্বদা সজাগ রির্টানিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার থেকে পোলিং অফিসার-এজেন্টরা।

চিত্রটা দেখে আসন্ন বিধানসভা ভোটের কথা মনে হওয়াটাই স্বভাবিক। দ্বিমত নন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারেরাও। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘আসন্ন বিধানসভা ভোটেরই নেট প্র্যাকটিস করছি!’’

প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বালি জুট কোম্পানি লিমিটেডের অছি পরিষদের পাঁচটি আসনের জন্য শ্রমিকদের মধ্যে নির্বাচন হয়। এ বারে সেই ভোটেই সিটু সমর্থিত বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের তরফে ‘ময়ূর’ চিহ্নে লড়ছেন পাঁচ জন। কিন্তু শাসকদলের প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। যেখানে আইএনটিটিইউসি-র নেত্রী দোলা সেনের সংগঠনের তরফে তিন প্রার্থী লড়ছেন ‘প্রদীপ’ চিহ্ন নিয়ে। আবার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের সংগঠনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন সাংসদ সৌগত রায়ের রাষ্ট্রীয় চটকল মজদুর সংগঠন। দু’জনেই নিজেদের মধ্যে পাঁচটি আসন ভাগ করে নিয়েছেন। শোভনদেববাবুর সংগঠনের দু’জন শ্রমিক লড়ছেন ‘দু’টি পাতা’ চিহ্নে এবং সৌগতবাবুর সংগঠনের তিন শ্রমিক লড়ছেন ‘সূর্য’ চিহ্নে। এই সবের পাশাপাশি আইএনটিউসি সংগঠনের হয়ে ‘গোলাপ ফুল’ চিহ্নে ভোটে লড়ছেন পাঁচ জন শ্রমিক। যাঁরা প্রত্যেকেই এলাকায় তৃণমূলকর্মী বলেই পরিচিত।

কিন্তু শাসকদলের বিভিন্ন সদস্য পরস্পরের মধ্যে এমন লড়াইয়ে নামলেন কেন? প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।

কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনকে সমর্থন করে বালির তৃণমূল বিধায়ক সুলতান সিংহের দাবি, ‘‘বালিতে দলীয় কর্মীদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া নেই। কে কার সঙ্গে রয়েছেন, জানি না। সুব্রত মুখোপাধ্যায় দলের বর্ষীয়ান নেতা। তাই তিনি যে সংগঠন তৈরি করেছিলেন, সেটাই একমাত্র সংগঠন বলে মনে করি।’’ তৃণমূলের হাওড়া জেলা সভাপতি (শহর) তথা মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘সব সংগঠনই একসঙ্গে আলোচনায় বসেছিল। কিন্তু কিছু হয়নি। একসঙ্গে ভোট করলে তো ভালই হত। বিষয়টা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনায় বসব।’’

বিষয়টি শুনে সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘আমি এখন আর ট্রেড ইউনিয়ন করি না। এক সময়ে ন্যাশানাল ইউনিয়ন অব জুট ওয়ার্কার্সের সভাপতি ছিলাম বলেই হয়তো আমার নামটা এখনও উঠে আসছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আইএনটিটিইউসি-র ক্ষেত্রেই বোধহয় এতগুলি সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক নয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন সব জায়গাতেই একটি মাত্র সংগঠন থাকবে। চা বাগানগুলির ক্ষেত্রে তা করেছি। এ বার জুট মিলগুলিতেও করতে হবে।’’ তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি শোভনদেববাবু বলেন, ‘‘সিটুকে হারাতে সকলের সঙ্গে বসা হয়েছিল। যে কোনও কারণেই হোক, আইএনটিইউসি ও দোলা সেনের সংগঠন জোট করার বিষয়ে রাজি হননি। তাই ওঁরা আলাদা প্রার্থী দেন।’’

তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এ দিন বালি জুট মিলের ভোট ঘিরে আশান্তির আশঙ্কা করেই প্রশাসনের কাছে নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছিলেন চটকল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিনের ভোটের জন্য শ্রীচরণ সরণি, বালি স্টেশন এলাকায় জারি হয় ১৪৪ ধারা। এ ছাড়াও এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে তিনটি থানার আইসি, ৩০ জন অফিসার, ৭০ জন কনস্টেবল এবং ২০ জন র‌্যাফ মোতায়েন করা হয়েছিল। পাশাপাশি, ২০টি সিসিটিভি ও তিনটি ভিডিও ক্যামেরাতেও নজরদারি চলেছে।

এ দিন এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, জুট মিল কোয়ার্টার্সের ভিতরে বসেছে বিভিন্ন সংগঠনের ক্যাম্প অফিস, জুট মিলের উল্টো দিকে রয়েছে পুলিশের ক্যাম্প। মিলের গেটে পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীরা শ্রমিকদের সচিত্র ইএসআই পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে তবেই ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেন। মিলের ভিতরেও পুরোপুরি ভোটের পরিবেশ। পাঁচটি বুথের সামনে ভোটারদের লম্বা লাইন। ভোটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। বুথের সামনেও পাহারায় রয়েছে পুলিশ। বুথের ভিতরে পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে বসে ভোট পরিচালনা করছেন প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসারেরা। ১৮ জন প্রার্থীর নাম ও চিহ্ন দেওয়া ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। আর বুথের বাইরে ঘুরে গলায় পরিচয়পত্র লাগিয়ে ঘুরছেন প্রার্থীরা। জটলা দেখলেই তেড়ে যাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। এ দিন ভোটের ডিউটি করতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন তুষারকান্তি সরকার নামে এক কনস্টেবল। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বালি জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার (পার্সোনেল ও প্রশাসন) অতনু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এ রকম শান্তিপূর্ণ ভোট কখনও হয়নি। এ বারই প্রথম হল।’’ আর এ দিনের ভোটের রির্টানিং অফিসার বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ভোট দেওয়ার পরে হাজিরা কার্ডে স্ট্যাম্প দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’

কিন্তু দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের যে চেহারা এ দিন বেরোলো, তাতে কি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হল না? অরূপবাবু বলেন, ‘‘জেলায় কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই নেই। তবে এই ভোটের বিষয়টি রাজ্য সংগঠনের ব্যাপার।’’

‘মধুর’ প্রাপ্তি, দিনের শেষে পাঁচটি আসনেই জিতেছে সিটু।

পরে শোভনদেববাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সকলকে নিয়েই ভোট করার চেষ্টা করেছিলাম। কেউ রাজি হলেন না। তাই এই ফল।’’ এমন ফল হওয়ায় অস্বস্তিতে মন্ত্রী অরূপবাবুও। বলেন, ‘‘এটা হওয়ার ছিল না। সিপিএমকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সকলে মিলে লড়া প্রয়োজন ছিল। একটা কারখানায় তো আমাদের একটাই ইউনিয়ন থাকার কথা। সেটি চার ভাগ হল বলেই সিপিএম জিতে গেল। ঊর্ধবতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE