Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘স্যর মারতেই পারেন’, বরাহনগরে অভিভাবকদের বিক্ষোভ প্রধান শিক্ষকের সমর্থনে

অভিভাবকেরাও বিক্ষোভ দেখান। তবে সেই বিক্ষোভ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিংবা পড়ুয়াকে মারার প্রতিবাদে নয়। বরং অন্যায় ভাবে প্রধান শিক্ষককে দোষারোপ করা হচ্ছে বলেই বক্তব্য বিক্ষোভকারীদের।

স্কুলশিক্ষা দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা অভিভাবকদের। বৃহস্পতিবার, বরাহনগরে। নিজস্ব চিত্র

স্কুলশিক্ষা দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা অভিভাবকদের। বৃহস্পতিবার, বরাহনগরে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২০
Share: Save:

বরাহনগরে উলটপুরাণ!

চলতি বছরের শুরুতে তোলা একটি গোপন ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক কয়েক জন খুদে পড়ুয়াকে দুষ্টুমির জন্য দুই আঙুলের ফাঁকে পেন ঢুকিয়ে চাপ দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সেই ছবি ভাইরাল হতেই তড়িঘড়ি তদন্ত শুরু করেন স্কুল শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা। অভিভাবকেরাও বিক্ষোভ দেখান। তবে সেই বিক্ষোভ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিংবা পড়ুয়াকে মারার প্রতিবাদে নয়। বরং অন্যায় ভাবে প্রধান শিক্ষককে দোষারোপ করা হচ্ছে বলেই বক্তব্য বিক্ষোভকারীদের।

যেই পড়ুয়াদের শাস্তি দেওয়ার ছবি দেখা গিয়েছে, তাদের অভিভাবকদেরই বক্তব্য, হেড স্যর যা করেছেন ঠিকই করেছেন। তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘আমরাই ওঁকে শাসন করার জন্য বলেছি। এই সামান্য শাসন না করলে বাচ্চারা মানুষ হবে না।’’ এখানেই থামেননি অভিভাবকেরা। কয়েক জন সোজা বরাহনগর থানায় গিয়ে লিখিত ভাবে জানিয়ে এসেছেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই।

কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগেই দেশ জুড়ে ছাত্রদের মারধর করা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নির্দেশিকায় বলা রয়েছে, পড়ুয়াদের শারীরিক নিগ্রহ করা ‌যাবে না। তা হলে বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক মনীষ নেজ তা মানেননি কেন? তিনি বলেন, ‘‘আমি ছাত্রছাত্রীদের কতটা আপন ভাবি, তা অভিভাবকেরাই বলতে পারবেন। দুষ্টুমি করলে একটু শাসন করি। না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় তো আমারই উপরে আসবে। চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।’’

আরও পড়ুন: টাকা চেয়ে সুচ ফোটায় দাদারা, নালিশ খুদেদের

২০১৭-এ শিক্ষারত্ন পুরস্কার পাওয়া মনীষবাবুর সঙ্গে সহমত অভিভাবকেরাও। ভিডিয়োর শেষে যে ছাত্রকে শাস্তি দিতে দেখা যাচ্ছে, সেই পদ্মনু মণ্ডলের মা কাকুলীদেবী বলেন, ‘‘আজ জানতে পারলাম, আমার ছেলে মার খেয়েছিল। ছেলে নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় করেছিল, তাই স্যর শাস্তি দিয়েছেন।’’ আর পদ্মনু বলছে, ‘‘স্যর আমাদের খুব ভালবাসেন। আমি তো মারামারি করেছিলাম, তাই আমার হাত চেপে ধরেছিলেন।’’

এ দিন উত্তর ২৪ পরগনার প্রাথমিক শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা এসে মনীষবাবুকে সতর্ক করেছেন। অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। অভিভাবকেরা এ দিন দাবি করেন, বছর খানেক আগে শাস্তি না দেওয়ার আইন লাগু হওয়ার বিষয়ে জানাতে বৈঠক ডেকেছিলেন মনীষবাবু। এক অভিভাবক মেঘা দত্ত বলেন, ‘‘বৈঠকে স্যরকে অনুরোধ করেছিলাম যাতে বাচ্চাদের শাসন করা হয়। না হলে ওরা মানুষ হবে না। বেঞ্চের উপরে উঠে বাচ্চারা লাফালাফি, মারামারি করে। পড়ে গিয়ে কারও মাথা ফাটলে কী হবে? এইটুকু শাসনে অন্যায় নেই।’’ অভি‌ভাবক সোনাক্ষী দাঁ, মৌ মিস্ত্রীদেরও একই বক্তব্য। তাঁরা বলছেন, স্যরকে পরিকল্পনা করে ফাঁসানো হচ্ছে। ‘‘বাড়িতেও আমরা বাচ্চাদের শাসন করি। আর স্কুলে তো ওরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সন্তানের মতোই,’’ বলেন তাঁদেরই এক জন।

অভিভাবকদের এই মনোভাবকে ভাল চোখেই দেখছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘ছেলেবেলায় দুষ্টুমির জন্য কত মার খেয়েছি। বাড়িতে সেটা জানতে পারলে ফের মায়ের কাছে মার, বকুনি খেয়েছি। এখন মনে হয়, ওই মার আশীর্বাদ ছিল। তবে এখন তো নতুন নিয়ম হয়েছে। তাই মনে হয় নির্মম ভাবে নয়, তবে একটু আধটু শাসন করা ভাল। না হলে পড়াশোনা, সহবত শিখবে কী করে? যদিও এখন অল্পতেই থানা-পুলিশ হয়, তাই শিক্ষক-শিক্ষিকারাও ভয়ে শাসন করেন না।’’

রাজ্য স্কুল শিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ এ দিন স্কুল থেকে বেরোনোর সময়ে দফতরের আধিকারিকদের ঘিরে অভিভাবকেরা দাবি তোলেন, স্যর না থাকলে তাঁরা বাচ্চাদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাব। আর খুদেরা আধিকারিকদের গাড়ির দরজা ধরে বলে, এই স্যরকেই তাদের চাই।

তবে লেখক ও প্রাক্তন আইএএস অফিসার অনিতা অগ্নিহোত্রীর মত, ‘‘শিশুর দৈহিক পীড়ন, বাড়িতে বা স্কুলে সমর্থনযোগ্য নয়। শিশুর দায়িত্ব বাবা-মা, শিক্ষকদের। বলপ্রয়োগ যত্নের মধ্যে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষক উভয় পক্ষেরই অন্যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE