সদ্য সংসার গুছিয়ে বসেছেন বছর আঠাশের রিয়া সেনগুপ্ত। কিন্তু হেঁশেল ঠেলার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। তাই সহজে রান্না শিখতে স্মার্ট ফোনে অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করে নিয়েছেন তিনি।
বছর পঞ্চাশের সুদীপ্ত বসু আবার ব্যাঙ্কের কাজ কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা সব কিছুই সারেন মোবাইলের অ্যাপে!
স্মার্ট ফোনের বাড়বাড়ন্তের যুগে এমন হাজারো অ্যাপ ঘুড়ে বেড়াচ্ছে সাইবার জগতে। তাদের মধ্যে অনেকেই হোয়্যাটস অ্যাপের মতো প্রবাদপ্রতিম না হলেও ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা নেহাত ফেলনা হয়। সেই সব অ্যাপের কেউ দিচ্ছে নিখরচায় এসএমএসের সুযোগ, কেউ বা দিচ্ছে আবহাওয়ার খবর কিংবা রাতের আকাশে কোন তারা কোথায় রয়েছে তার হদিস! এই সব অ্যাপ ব্যবহার করার মজাটাও নেহাত কম নয়।
তবে এই সব অ্যাপ কতটা নিরাপদ, সেই প্রশ্নও কিন্তু তুলছেন পুলিশ ও সাইবার বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, অ্যাপে যেমন মজা রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিপদের ফাঁদও। সেই ফাঁদে পা দিলে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াটা অসম্ভব নয়। কেন?
সাইবার বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, এই সব অ্যাপের সঙ্গে বহু সময়েই ভাইরাস লুকিয়ে থাকে। সেই অ্যাপ ডাউনলোড করলে সেই ভাইরাসও মোবাইল ফোনে ঢুকে পড়বে। তার ফলে ব্যক্তিগত তথ্য বেআব্রু হয়ে পড়তে পারে হ্যাকারদের সামনে। সম্প্রতি হোয়্যাটস অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অনেকেই অ্যাপটি ‘আপগ্রেড’ করার জন্য একটি বিশেষ লিঙ্ক পেয়েছিলেন। এক যুবক বলছেন, লিঙ্কটি খোলা মাত্রই তাঁর ফোনে থাকা সব নম্বরে উদ্ভট এসএমএস চলে গিয়েছিল।
শুধু ফোন-ই নয়, অ্যাপ মারফত নিজের ব্যক্তিগত তথ্যও বেআব্রু হয়ে পড়তে পারে। অনেক অ্যাপে নিজের মোবাইল নম্বর ও ই-মেল অ্যাকাউন্টের তথ্য দিতে হয়। এক সাইবার বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘সেই অ্যাপ মারফত হ্যাকাররা যে ই-মেল ও মোবাইল ঘেঁটে দেখবে না, তা কে বলতে পারে?’’
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ হয়তো ব্যক্তিগত ছবি তুলে মেসেজ পাঠানোর অ্যাপে তা বন্ধুকে পাঠালেন। তার পরে দু’জনেই মোবাইল থেকে তা মুছে দিলেন। কিন্তু সেই তথ্যটা পুরোপুরি মুছল না। বরং তা ওই সার্ভারে রয়ে গেল। এখানেই বিপদের আশঙ্কা রয়ে যায়। কী ভাবে?
সাইবার ফরেন্সিক ও আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়য়ের কথায়, ‘‘নিখরচার অ্যাপে শেয়ার করা যাবতীয় তথ্য ভাড়া করা সার্ভারে জমা থাকে। খরচ কমাতে সেগুলির নিরাপত্তার উপরেও জোর দেওয়া হয় না। সেই তথ্যের নিরাপত্তার ভারও সংশ্লিষ্ট সংস্থা নেয় না। তাই ওই সার্ভারে হ্যাকার হানা হলে ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি দুষ্কৃতীদের হাতে চলে যেতে পারে।’’
বস্তুত, এই ধরনের সার্ভারে হ্যাকার হানা নিয়ে গত বছরই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। আই ফোন ব্যবহারকারীরা তাঁদের অনেক তথ্যই সার্ভারে জমা রাখেন। সেই সার্ভারে হ্যাকার হানার ফলে হলিউডের অনেক তারকার ব্যক্তিগত ছবি চুরি করে সাইবার জগতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘটনায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তদন্তে নামলেও এখনও সুরাহা করতে পারেনি।
তবে অ্যাপ মানেই যে মারাত্মক বিপদ, তা মানতে নারাজ একটি অ্যাপ্লিকেশন প্রস্তুতকারক সংস্থার কৌশিক মৌলিক। তাঁর মন্তব্য, গুগ্ল প্লে থেকে ডাউনলোড করা অ্যাপ অনেক বেশি নিরাপদ। তার কারণ, ওই সব অ্যাপ গুগ্ল নিজে পরীক্ষা করে নেয়। সন্দেহজনক মনে হলে তা বন্ধও করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, কে ওই অ্যাপ সরবরাহ করছে, তারও তথ্য থাকে। ফলে অপরাধ করলেও পুলিশ পাকড়াও করতে পারবে। কিন্তু সেই দুষ্টু হ্যাকার যদি বিদেশে বসে থাকে কিংবা হানা দেয় সরাসরি সার্ভারে? কৌশিকবাবুর বক্তব্য, ‘‘সে ক্ষেত্রে বিপদ থাকে। কিন্তু এমন বিপদ কোথায় নেই?’’ গুগ্ল ইন্ডিয়ার কর্পোরেট কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান পরমা রায়চৌধুরীও বলছেন, ‘‘গুগ্ল প্লে-তে দেওয়া অ্যাপগুলি খতিয়ে দেখা হয়। একটা নিয়মিত রিভিউয়ের মধ্যে দিয়েও সেগুলি যায়।’’
একই কথা বলছেন নতুন প্রজন্মের অনেকেই। তাঁদের কথায়, এসএমএস করার থেকে এই ধরনের অ্যাপে মেসেজ করার খরচ অনেক কম। ছবি বা গানও পাঠানো যায়। ফলে গোটা জিনিসটাই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কর্পোরেট জগতের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বলছেন, সিনেমা কিংবা বাসের টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর সময় মেলে না। তাই অফিসে বসেই সেই কাজগুলো অ্যাপে সেরে নেন তাঁরা।
এমনই এক জন মোবাইল অ্যাপপ্রেমী তরুণ ব্যবসায়ী জয়ন্ত ঘোষ। বিপদের কথা জেনেও নিয়মিত অ্যাপ ডাউনলোড করেন কেন?
জয়ন্ত বলছেন, অ্যাপ ব্যবহারের নানা সুবিধা রয়েছে। তা ছাড়া, কোথা থেকে কী জন্য ডাউনলোড করছি, সেটাও মাথায় রাখতে হয়। অ্যাপের বিপদ ঠেকাতে উন্নত অ্যান্টি ভাইরাসও ব্যবহার করা জরুরি।
ওই ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘বিপদ ঠেকাতে নিজেকেই সতর্ক থাকতে হবে।’’ সাইবার বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করার আগে তার ব্যাপারে ভাল ভাবে খতিয়ে দেখে নেওয়া দরকার। নামী সংস্থার ট্যাক্সি বা সিনেমার টিকিট বুকিংয়ের অ্যাপ নিরাপদ থাকে। কিন্তু পর্নোগ্রাফি কিংবা অদ্ভুত প্রতিশ্রুতি দেওয়া থাকলে সেই সব অ্যাপ এড়িয়ে চলাই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy