দখল: দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি ও ফুটপাতের দোকানে ঢেকেছে গিলান্ডার হাউসের প্রবেশপথ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
হাতিগুলো চেন দিয়ে বাঁধা রয়েছে! না হলে সেগুলো তো কবেই নিয়ে চলে যেত।
হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলেন ভদ্রলোক। বড় লোহার গেট দিয়ে ঢোকার মুখেই দরজার দু’দিকের থামের উপরে হাতিগুলো চোখে পড়বে। একটু খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে, হাতিগুলো সত্যিই চেন বাঁধা রয়েছে। শুরুর থেকেই কি সেগুলো চেনে বাঁধা ছিল? ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ একদম সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই,’’— বলছিলেন গিলান্ডার হাউসের ওই কর্মী।
কিন্তু চেন দিয়ে বাঁধা কেন? তার কোনও উত্তর নেই। শুধুমাত্র স্থাপত্যশৈলী? হতে পারে! তবে নিশ্চিত নন কেউই। আর হবেনই বা কী ভাবে। কারণ, ভবনটির স্থপতি যে একটু খামখেয়ালি ছিলেন। যখন তাঁকে গিলান্ডার হাউস তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল, তখন স্থপতি, গ্যারি স্টুয়ার্ট গুডহার্ট রেন্ডল তো ট্রিনিটি কলেজে মিউজিক নিয়ে পড়ছেন। মিউজিকের সঙ্গে অতঃপর নির্মাণশৈলী মিলেমিশে গেল।
তাই বোধহয় গিলান্ডার হাউসের বিশালাকৃতি লোহার গেটের সিংহও বিস্ময় উদ্রেক করছে অনেকের। সিংহ, হাতি বা ফিনিক্স পাখি কলকাতার ব্রিটিশ স্থাপত্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু কোনওটার সঙ্গে কোনওটার যেন মিল নেই। সবই যেন আলাদা। যেমন রাইটার্স বিল্ডিংসের বি বা দী বাগের উত্তর প্রান্তের প্রবেশ দ্বারের মুখে খোদিত যে সিংহ রয়েছে, তার সঙ্গে গিলান্ডার হাউসের গেটে খোদিত সিংহের একটা পার্থক্য রয়েছে— জানাচ্ছেন হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ। রাইটার্স বিল্ডিংসের সিংহ যেন বয়সভারে ন্যুব্জ, কিছুটা বিষণ্ণও, সেখানে গিলান্ডার হাউসের সিংহ রীতিমতো গর্জনরত!
‘‘এত পুরনো জিনিস। তবু কিচ্ছু হয়নি এখনও’’— হাউসের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী কথাগুলো বলছিলেন। ভবনের নির্মাণের সময় পাথরের ব্যবহারে কোনও কার্পণ্য করা হয়নি। জানলাগুলিতেও ‘সাজসজ্জা’ রয়েছে যথেষ্ট। লোহার গেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধনুকের ছিলার মতো প্রবেশদ্বারের মুখ। কিন্তু চিন্তা সবসময় থাকে, বলছিলেন ওই কর্মী। সব সময়েই নজরে রাখতে হয় চারপাশে। ভবনের পুরনো সামগ্রী কেউ নিয়ে যাচ্ছে না তো!
কর্মীরাই জানালেন, এমনিতে পুরো ভবন জুড়েই হকার-সাম্রাজ্য! ভবনটিকে বৃত্তাকারে ঘিরে রয়েছেন হকারেরা। শুধু তাই নয়, ভবনের সামনেই যেখানে-সেখানে গাড়ি দাঁড় করানো হয়। হেয়ার স্ট্রিট থানায় বিষয়টি নিয়ে একাধিক বার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। হাউসের দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মূল প্রবেশদ্বার বাদ দিয়ে পিছনের দিকেও একটি দরজা রয়েছে। তবে সবসময় খোলা হয় না সেটি। তার কারণ বহিরাগতদের উপদ্রব! ‘‘অন্য সময় খোলা থাকলে তো ভিতরে বাজার বসে যাবে! দিনে যে দু’বার খোলা হয় পিছনের গেটটি, সেইটুকু সময়ের মধ্যেই অগুনতি লোকজন, হকারেরা যাতায়াত করেন হাউসের ভিতরের রাস্তা দিয়ে। এখানকার কর্মীদেরই ঢুকতে অসুবিধা হয়,’’— বলছিলেন এক কর্মী। ওই কর্মীই জানালেন, অতীতে যখন গেট খোলা থাকত, তখন ভিতরে আক্ষরিক অর্থেই বাজার বসেছে বলে মনে হতো! সে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা! তার পরেই পিছনের গেটটি সবসময় না খোলার সিদ্ধান্ত হয়। বছর চারেক আগে গিলান্ডার হাউসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তার পর থেকে বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে এখানে ‘ফায়ার ড্রিল’ করা হয়।
এমনিতে গিলান্ডার হাউস, ৮, নেতাজি সুভাষ রোডের ঠিকানায় আপাতত ৭০টি সরকারি-বেসরকারি অফিসের ঠিকানা। তার মধ্যে এইচএসবিসি, এসবিআই-এর অফিস যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত সংস্থার অফিস। প্রসঙ্গত, ১৯০৯ সালে ভবনটি নির্মাণের পরে গিলান্ডার আরবাটনট অ্যান্ড কোম্পানির বাণিজ্যের বিস্তার হয়েছিল এই ভবন থেকেই। পরবর্তী কালে গিলান্ডার অ্যান্ড কোম্পানি কোঠারি গ্রুপের সঙ্গে মিশে যায়।
অবশ্য ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে ব্রিটিশ বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গত কারণ ছিল বলেই মনে করছেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। ‘আমরা এখানে থাকতে এসেছি, আমরাই এখানকার শাসক!’— ব্রিটিশ-রাজের এই বার্তা মিলেমিশে গিয়েছে এখানকার প্রতিটি ভবনের নির্মাণের সঙ্গে। এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘ব্রিটিশ শাসকদের ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে এখানকার নির্মাণশৈলীতেও! শহরের অন্য জায়গার সঙ্গে এখানকার বিল্ডিংয়ের একটা স্পষ্ট প্রভেদ রয়েছে। এটা যে আমাদের এলাকা, এটাই বলতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা।’’ কোঠারি গ্রুপের এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাড়িটার সঙ্গে যে ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে, তা আমরা জানি। সবই সংরক্ষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
কিন্তু হলে কী হবে! সংরক্ষিত ইতিহাসে তো এখন হকার ও বেআইনি পার্কিংয়ের দাপট! আসলে রেন্ডল তো আর জানতেন না, উত্তর-ঔপনিবেশিক কলকাতায় যান চলাচল থেকে শুরু করে পথচারীদের যাতায়াত, সবেতেই অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করে হকার-সাম্রাজ্য! জানলে তিনি গিলান্ডার হাউসের পিছনের গেটের পরিকল্পনা করতেন না হয়তো! শুধু সামনের গেটটাই থাকত, গর্জনরত সিংহকে সঙ্গে নিয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy