টাউন হলে চলছে সংস্কারের কাজ। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
কোনও বাড়ির ঐতিহাসিক তথ্য ঘাঁটা, সরেজমিনে পরিদর্শন করা— এ কি মুখের কথা! বছর-বছর তো একই ভাবে চলেছে। সেই ১৯৯৭-’৯৮ সাল থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হেরিটেজ নিয়ে শহরে শোরগোল বেড়েছে। কিন্তু সেই হেরিটেজ রক্ষায় কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের সাম্মানিক যা ছিল তা-ই আছে। এ বার সেই সাম্মানিক বাড়াতে কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন হেরিটেজ কমিটির সদস্যদের একাংশ।
হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, হেরিটেজ নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হলেও বাস্তবে শহরের হেরিটেজ-চিত্রের তেমন কোনও পার্থক্য হয়নি। তাঁদের সাফ বক্তব্য, হেরিটেজ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যতটা সক্রিয়তা, বাস্তবে তার সিকি ভাগও থাকলে গ্রেডেশনপ্রাপ্ত একের পর এক বাড়ি এত সহজে ভেঙে ফেলা যেত না। এ নিয়ে পুরসভার হেরিটেজ কমিটির দিকেই আঙুল তুলেছেন তাঁরা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বর্তমানে ‘হেরিটেজ ওয়াক’-এর আয়োজন করে, ব্যক্তিগত ভাবেও অনেকে ‘গাইড’-এর কাজ করেন। কিন্তু শহরের হেরিটেজ-মনস্কতা এখনও সাবালক হয়ে উঠতে পারেনি বলেই মত বিশেষজ্ঞদের। হেরিটেজ স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘হেরিটেজের কাজে পেশাদারদের প্রয়োজন। এটা শিক্ষানবিশদের কাজ নয়।’’ আর এক হেরিটেজ স্থপতি হিমাদ্রি গুহ বলছেন, ‘‘পুরনো বাড়ি কী ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট একটা সরকারি নীতি নেওয়া প্রয়োজন।’’
হেরিটেজ কমিটির সদস্যদের বক্তব্য, হেরিটেজ নিয়ে কাজ করতে হলে সাম্মানিক বাড়ানোটাও প্রয়োজন। কারণ সাধারণ কাজের সঙ্গে হেরিটেজ সংরক্ষণের কাজের পার্থক্য রয়েছে। কোনও বাড়ির ইতিহাসের প্রেক্ষিত খুঁজে দেখা বা লোকমুখে প্রচলিত কোনও ইতিহাসকে যাচাই করা, স্থাপত্যশৈলীর ভিত্তিতে কোনও বাড়ি আদৌ হেরিটেজ গ্রেডযোগ্য কি না তা পরখ করা — কোনওটাই মামুলি বিষয় নয়! তাই সাম্মানিক বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা।
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, হেরিটেজ কমিটির এক সদস্যের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে হেরিটেজ কমিটির সদস্যদের সাম্মানিক বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে তাঁদের সাম্মানিক আড়াই হাজার টাকা। সেই পরিমাণ বাড়িয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য শুধু কমিটির সদস্যদেরই নয়, পুরসভার ওয়াটার বডি ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্যদেরও একই পংক্তিতে রাখা হয়েছে। হেরিটেজ কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘হেরিটেজ নিয়ে এত কথা হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে হবে যে, এ ক্ষেত্রে ঠিক ভাবে কাজটা করতে হলে উপযুক্ত সাম্মানিকও প্রয়োজন। খুব বেশি বাড়ানোর কথা তো
বলা হয়নি!’’
পুর-তথ্য জানাচ্ছে, শেষ বার ২০১৪ সালে এই সাম্মানিকের পরিমাণ দেড় হাজার থেকে বেড়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছিল। সে সময়ে অবশ্য কেনিলওয়ার্থ হোটেল ভাঙার মতো বিতর্ক তৈরি হয়নি। গ্রেডের অবনমন ঘটিয়ে বাড়ি ভেঙে ফেলার মতো অভিযোগও ওঠেনি পুর হেরিটেজ কমিটির দিকে। ওই কমিটির কাজকর্ম নিয়েও প্রশ্ন তোলেনি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। তাই তখন সাম্মানিক আদৌ বাড়ল কি না, বা কতটা বাড়ল তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। পুরসভার হেরিটেজ-তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি যেন আজ আলোচ্য বিষয়, তেমনই সকলের নজরে সাম্মানিক বাড়ানোর এই আবেদনও। পুরসভার এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, ‘‘অতীতে হেরিটেজ কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানের যে হেরিটেজ তালিকা পুরসভার রয়েছে, তা সে সময়েই তৈরি। তখন সকল সদস্যই খুব পরিশ্রম করে কাজটা করেছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে সেই তালিকার আর কোনও সংশোধন হল না!’’
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল ওঠার ফলে পাল্টে যাচ্ছে কলকাতার স্কাইলাইন। শহরের উচ্চতম বহুতল নিয়ে যেমন সগৌরব আলোচনা শুরু হয়েছে, তেমনই আলোচনার কিছুটা অন্তত বরাদ্দ থাক শহরের ঐতিহ্যের জন্য। এক হেরিটেজ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘স্থাপত্যশৈলীর অনন্যতা, ইতিহাস খোঁজার জন্য শ্রমের বিনিময়ে সাম্মানিক বাড়ছে বাড়ুক, কিন্তু পুরনো কলকাতার ইতিহাসটুকু অক্ষুণ্ণ থাক। তা হলেই হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy