বাসে এমনই র্যাম্প বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন।
সরকারি বাসে যাতায়াতের সময়ে নিজেদের অধিকার থেকে বহু ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। অন্য কেউ নন, এমনটা মনে করছে খোদ পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশন।
কমিশন জেনেছে, সরকারি বাসে বহু প্রতিবন্ধী নিখরচায় যাতায়াত করতে পারছেন না। অথচ এটা তাঁদের আইনে স্বীকৃত অধিকার। আবার সরকার যদি মনে করে, কোনও প্রতিবন্ধীর সঙ্গে ‘এসকর্ট’ বা সহায়ক থাকা জরুরি, তা হলে সেই সহায়কও বিনা টিকিটে যেতে পারবেন। কিন্তু এ সব বলতে গেলে উল্টে সরকারি বাসকর্মীদের একাংশের কাছে হেনস্থা ও অপমানিত হতে হচ্ছে বহু প্রতিবন্ধীকে। এমনকী, বাস থেকে তাঁদের ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়!
আবার কোনও প্রতিবন্ধী নিজেই হুইলচেয়ারে করে বাসে উঠে যেতে পারবেন, সেই সুবিধে অর্থাৎ বাসের পাদানির সঙ্গে ঢাল বা র্যাম্প এখানে নেই। যা বিশ্বের অন্য বহু দেশে আছে।
কলকাতা বা রাজ্যে প্রতিবন্ধীদের এই অবস্থার কথা সম্প্রতি উঠে এসেছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে আসা একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে। অভিযোগকারী সন্তোষপুর অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা, ৩৬ বছরের ইন্দ্রজিৎ রায়ের ডান পা জন্ম-ইস্তক স্বাভাবিকের তুলনায় দু’ইঞ্চি ছোট। দু’বার অস্ত্রোপচারেও লাভ হয়নি। কোমরের নীচে, ডান দিকে ইস্পাতের পাত বসানো। কারও সাহায্য ছাড়া তাঁর পক্ষে চলাফেরা করা মুশকিল। রাজ্য সরকারের প্রতিবন্ধী কমিশনারের অফিস থেকে ২০১৩-য় দেওয়া পরিচয়পত্রে তাঁর ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ রয়েছে এবং বলা হয়েছে, তিনি সঙ্গে ‘এসকর্ট’ বা সহায়ক রাখার সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ, সরকারি যানবাহনে প্রতিবন্ধী নিজে এবং সহায়ক দু’জনেই নিখরচায় যাতায়াত করতে পারবেন।
কিন্তু বিমা সংস্থার কর্মী ইন্দ্রজিৎবাবুর অভিযোগ, বহু সময়েই সরকারি বাসে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সহায়ক-সহ তাঁর নিখরচায় যাতায়াতের অধিকারের কথা জানালে আমল দেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে চালক ও কন্ডাক্টর তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও শারীরিক নিগ্রহও করেন।
এমনকী ওই প্রতিবন্ধী যুবকের দাবি, ‘‘এমনও হয়েছে, বাসের চালক-কন্ডাক্টর আমাকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়েছেন। যে কোনও সময়ে আমার বড় বিপদ হতে পারত।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমি প্রতিবন্ধী বলে কি ন্যূনতম মানসম্মানটুকু নিয়ে বাঁচার অধিকার নেই?’’ তিনি বলছেন, ‘‘বহু সময়ে সরকারি বাস আমাকে দেখলে স্টপে থামে না। থামলেও এত অল্প সময়ের জন্য থামে যে, আমার পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়। আবার কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্টপে বাস না থামিয়ে পরের স্টপে নামানো হয়।’’
প্রতিবন্ধীদের অধিকার অর্জনে দীর্ঘকাল কাজ করে যাওয়া রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি বাসের যে সব কর্মী প্রতিবন্ধীদের হেনস্থা করেন, বেআইনি ভাবে প্রতিবন্ধীদের কাছ থেকে ভাড়া চান, আইনে তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। না হলে এই অমানবিকতার শেষ হবে না।’’
গত বছর জুলাইয়ে ইন্দ্রজিৎ রায়ের অভিযোগ পাওয়ার পরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন তা পরিবহণ দফতরে পাঠায়। কমিশন সূত্রের খবর, পরিবহণ দফতর অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে এবং সেই মতো পদক্ষেপও করেছে। তবে কমিশন মনে করছে, এটা এক জন বা দু’-একটি ঘটনা নয়, সরকারি বাসে প্রতিবন্ধীদের কী কী অধিকার আছে, সে ব্যাপারে বহু সরকারি কর্মীরই সচেতনতা নেই। তার জন্য সচেতনতার প্রচার ও প্রসার জরুরি বলে কমিশনের অভিমত। ২০ এপ্রিল কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাপরাজিত মুখোপাধ্যায় ও সদস্য মণিশঙ্কর দ্বিবেদী পরিবহণ দফতরকে জানান, সরকারি বাসের বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের নিয়ে অবিলম্বে শিবির করা প্রয়োজন। পরিবহণ দফতর এর আয়োজন করুক, তবে তারা চাইলে কমিশন বিশেষজ্ঞদের সেখানে পাঠাতে পারে।
সরকারি বাস সংস্থাগুলির সঙ্গে বেসরকারি বাস অপারেটরদেরও শিবিরে সামিল করার কথা বলেছে কমিশন। তবে ১৯৯৫-তে চালু হওয়া আইনে প্রতিবন্ধীদের সরকারি বাসে নিখরচায় যাতায়াতের অধিকার স্বীকৃত। তাতে বেসরকারি যানবাহনের কথা বলা নেই। সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।
সরকারি বাসে উঠতে প্রতিবন্ধীরা যাতে বাধার সম্মুখীন না হন, সেই জন্য যে সব বাসে সম্ভব, সেগুলিতে ঢালের ব্যবস্থা রাখতেও পরিবহণ দফতরকে বলেছে কমিশন। ওই সব ঢাল অন্য সময়ে ভাঁজ করা থাকবে। এ ক্ষেত্রে কলকাতা বিমানবন্দরে টার্মিনাল থেকে বিমান পর্যন্ত যাত্রীদের যে ধরনের বাসে নিয়ে যাওয়া হয়, তার উদাহরণ দিয়েছে কমিশন।
কমিশনের সুপারিশ কি পরিবহণ দফতর মানবে? পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি বাসে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বাসকর্মীদের সচেতন করতে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ নিশ্চয়ই মানা হবে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রতিবন্ধীরা যাতে হুইল চেয়ারে বাসে উঠতে পারেন, সেই ব্যবস্থা সাধারণ ভাবেই থাকা উচিত।’’ পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, পা-দানি লাগোয়া ঢাল নিয়ে সুপারিশ কার্যকর করতে খরচ ও প্রযুক্তিগত দিকটি খতিয়ে দেখা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy