Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নজর থাকছে ক্লাসঘরে, সন্দেহ বাড়ছে সম্পর্কে

পড়ুয়া আর শিক্ষকের মধ্যে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক আদানপ্রদানের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যায় এতে। বাগুইআটি অঞ্চলের একটি স্কুলের শিক্ষক সঞ্চারী সাহা চান ছাত্রীদের বোঝাতে যে, সিসিটিভি একটি নিয়ম মাত্র। আসলে মুক্ত মনেই মেশা যায় শিক্ষকদের সঙ্গে। কিন্তু তাতেই কি সংশয় যাবে, প্রশ্ন তাঁরও।

সুচন্দ্রা ঘটক
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫৩
Share: Save:

নিজের সাফল্যের মুহূর্তে ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষকের নাম করে বিদেশি গ্রন্থাগারে বই দান অথবা গবেষণার থিসিস উৎসর্গ করা স্কুলের প্রথম শ্রেণির মাস্টারমশাইয়ের নামে— এমন কিন্তু এখনও ঘটে! বাংলা সাহিত্যেও তেমন শিক্ষকদের ঘাটতি নেই, যাঁরা নিজের ছাত্রছাত্রীদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছেন আজীবন।

অথচ সেই ভিতটাই এখন প্রশ্নের মুখে। বছর শেষের মাসটা জুড়ে চলা টানাপড়েন, তা ফের মনে করিয়েছে। শিক্ষক না পড়ুয়া, কোন পক্ষ ঠিক? সেই চর্চার জেরে সঙ্কটে আরও বহু শিক্ষকের সম্মান, অনেকগুলো সম্পর্কের শক্তি।

সম্প্রতি জি ডি বিড়লা স্কুলে এক পড়ুয়াকে নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে শিক্ষক এবং পড়ুয়া পক্ষের মধ্যে প্রকট দলাদলি দেখেছে সমাজ। এই পরিস্থিতি যে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে এ বছরই ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনা। গত নভেম্বরেই ডিসলেক্সিক ছাত্র সঙ্কল্প দাসের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আর্জি নিয়ে স্কুলের বিরুদ্ধে মামলা গড়িয়েছিল হাইকোর্ট পর্যন্ত। বাগুইআটি অঞ্চলের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার পড়ুয়াদের সঙ্গে ব্যবহার নিয়েও হয়েছিল হইচই।

সে সব দেখেই কারও দাবি, শিক্ষকেরা আগের মতো সম্মানের আসনে নেই। কেউ বা বলেন, ছিঁড়েই গিয়েছে সম্পর্কের বাঁধন। ফলে ক্লাসরুমে শিক্ষকের আচরণের উপরে বিশেষ নজর রাখতে ক্যামেরা বসল কি না, খেয়াল রাখতে শেখে পড়ুয়া। স্কুলের সঙ্গে ভাল ভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই ‘গুড টাচ’ এবং ‘ব্যাড টাচ’ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতে হয় খুদেকে। শিক্ষকের হাতে দু’ঘা খেলে একেবারেই ভয় না পেয়ে অভিভাবকের কাছে নালিশ জানানোর পাঠ নিতে হয় স্কুল-জীবনের গোড়া থেকেই। আর এর গুঁতোয় শৈশব থেকে অতি নির্ভরশীল এক সম্পর্কের মাধুর্য হারাচ্ছে বলে মন খারাপ করে ছোট্ট একটা অংশ। যার মধ্যে আছেন শিক্ষক, অভিভাবক থেকে সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদেও।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সমাজের একটি অতি গুরুত্বর্পূণ ভিত বলেই মনে করেন তাঁরা। দু’-একটি ঘটনা যেন বড়ই সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে। ফলে ইতিমধ্যেই দফায় দফায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে তা ফিরিয়ে আনতে হয়েছে আলোচনা।

তবে তা হবে কী ভাবে, তা নিয়েই চিন্তায় শিক্ষক-সমাজ। মডার্ন হাই স্কুলের ডিরেক্টর দেবী করের যেমন মন খারাপ হয় ক্লাসে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর প্রসঙ্গ উঠলেই। তাঁর মতে, ‘‘বাড়তে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার সংখ্যাই বুঝিয়ে দেয় সম্পর্কে চড়তে থাকা সন্দেহের মাত্রাটা।’’ পড়ুয়া আর শিক্ষকের মধ্যে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক আদানপ্রদানের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যায় এতে। বাগুইআটি অঞ্চলের একটি স্কুলের শিক্ষক সঞ্চারী সাহা চান ছাত্রীদের বোঝাতে যে, সিসিটিভি একটি নিয়ম মাত্র। আসলে মুক্ত মনেই মেশা যায় শিক্ষকদের সঙ্গে। কিন্তু তাতেই কি সংশয় যাবে, প্রশ্ন তাঁরও।

ভালবাসাই শিক্ষক ও পড়ুয়ার সম্পর্ক থেকে হারাতে বসা বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র। তাঁর বক্তব্য, আগামী দিনে এই সম্পর্কে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। ‘‘কী কী উপায়ে এই শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাস ফেরানো যায়, সেইটাই ভাবনার,’’ মন্তব্য অভিজিৎবাবুর।

সেই বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরানোর দায় যেমন শিক্ষক ও অভিভাবকদের, তেমনই সমাজমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমেরও। কারণ বিশেষজ্ঞদের মত, এই সব মাধ্যমেই ভরসা করে সাধারণ সমাজ। মনোবিদ তথা শিক্ষক নীলাঞ্জনা স্যান্যালের বক্তব্য, কোনও খারাপ ঘটনা বারবার আলোচিত হলে সেইটাই একমাত্র সত্যি বলে ভেবে নেয় সমাজ। ফলে খারাপের সঙ্গে ভাল ঘটনাও তুলে ধরা প্রয়োজনীয়। না হলে এক জন শিক্ষক ভুল করলে, তা সকলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। তবে সমস্যাটা আরও গভীর। তাই পরিস্থিতি বদলাতে নানা দিক ভাবতে হবে। যার ফলে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার দিকেও জোর দিচ্ছেন অনেকে। বহু মনোবিদের মতেই, শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখার সঙ্গে নেওয়া যায় একটি পার্সোনালিটি টেস্টও। কর্মপ্রার্থীর মধ্যে শিক্ষকসত্ত্বা যথেষ্ট জাগ্রত কি না, তাতেই বোঝা যাবে। তবে শুধু শিক্ষকের উপরেই সম্পর্কের সম্পূর্ণ দায় থাকে না, সন্তানের পড়াশোনা শুরুর সময় থেকে সে দায়িত্ব অভিভাবকদেরও নিতে হবে বলে মনে করান বিশেষজ্ঞেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Class New Year Teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE