Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

‘হুইলচেয়ার নিয়ে বেরিয়ে বুঝলাম, শহর সচেতন নয়’

আমার আট বছরের মেয়ে দেবস্মিতা হুইলচেয়ারে বন্দি। দুরারোগ্য বিরল স্পাইনাল মাস্কুলার আ্যট্রফি আক্রান্ত।

মেয়ে দেবস্মিতাকে নিয়ে একটি মণ্ডপে মৌমিতা। নিজস্ব চিত্র

মেয়ে দেবস্মিতাকে নিয়ে একটি মণ্ডপে মৌমিতা। নিজস্ব চিত্র

মৌমিতা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৫১
Share: Save:

আমার আট বছরের মেয়ে দেবস্মিতা হুইলচেয়ারে বন্দি। দুরারোগ্য বিরল স্পাইনাল মাস্কুলার আ্যট্রফি আক্রান্ত। এই রোগে ওর শরীরের সব মাংসপেশী পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো প্রায় অসাড়। কিন্তু ওর ছোট্ট মন যে পাঁচ জন শিশুর মতোই মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে দুর্গা ঠাকুর দেখতে চায়। আমরা, মানে ওর মা-বাবা, চাই ওর এই ছোট্ট সাধ পূরণ করতে। কারণ এই রোগ বড় অনিশ্চিত। আগামী বারের পুজোটা ও ভাল ভাবে দেখতে পাবে কি না, জানা নেই। তাই এই পুজোর আনন্দের মাঝে আমরাও বেরিয়ে পড়েছিলাম মেয়েকে নিয়ে।

কিন্তু এ শহরের আনন্দ মরসুমে হুইলচেয়ার নিয়ে বেরোনোর অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম। কেউ সাহায্য করতে আসেননি তা নয়, তবে অনেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের অসুস্থ মেয়ের জন্য জায়গা নেই এই শহরে। কারণ হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকার মতো রাস্তাই নেই অধিকাংশ পুজো প্রাঙ্গণে। ফলে পুজোকর্তারা আমার মেয়েকে ঢুকতে দিতে ইচ্ছুক হলেও অনেক জায়গায় প্রতিমার সামনে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিই ছিল না।

শুরু করেছিলাম বাড়ির কাছের নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজো দিয়ে। পুলিশ থেকে ক্লাবের সদস্যেরা সকলেই সাহায্য করেছেন মেয়েকে প্রতিমা দর্শন করাতে। ওঁরা ভিড় বাঁচিয়ে দেবস্মিতাকে একেবারে প্রতিমার সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই আন্তরিকতায় আমরা অভিভূত। মণ্ডপটিও মোটামুটি ভাবে হুইলচেয়ারের প্রবেশযোগ্য। তবে ওই একটিই, এ ছাড়া আমরা বেশি নামী পুজোয় যাইনি। কারণ, সে সব জায়গায় বড় ভিড়। বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে মেয়ের হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়, এমন কিছু মণ্ডপেই গিয়েছি। নামী পুজো দেখতে হলে বাকি দর্শনার্থীদের মতোই আমার মেয়েকেও ভিড় ঠেলে চলতে হত। যা ওর পক্ষে খুবই কষ্টের।

ছ’দিনে প্রায় ৭৫টি পুজো দেখতে গিয়েছি। কিছু হুইলচেয়ারের প্রবেশযোগ্য, কিছু নয়। যেগুলি প্রবেশযোগ্য নয়, তার মধ্যেও কয়েকটি পুজোর সদস্যেরা এগিয়ে এসেছেন আমার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে। সবাই মিলে হুইলচেয়ার ধরে সিঁড়ি পার করে দিয়েছেন। চেয়ার বার করতে সাহায্য করেছেন। দু’টি মণ্ডপের কথা বিশেষ ভাবে মনে থাকবে— রানিকুঠির কাছে সেবক সঙ্ঘ আর নেতাজিনগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব। সেবক সঙ্ঘের সদস্যদের অনুরোধ করতেই ওঁরা এগিয়ে আসেন হুইলচেয়ার ধরে সিঁড়ি পার করে দিতে। নেতাজিনগরে সাহায্য পেয়েছি চাওয়ার আগেই। তবে বহু মণ্ডপ দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কারণ সেখানে হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকা অসম্ভব। খারাপ লাগার জন্ম সেখানেই। মণ্ডপে না ঢুকতে পারাটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমার মেয়ে বাকিদের মতো সক্ষম নয়। ওর আশাহত দৃষ্টির যন্ত্রণা নীরবে মেনে নিতে হয়েছে আমাদের। এই অসহায়তাই বড্ড হতাশাজনক। সমাজের এক অংশের এই নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুব প্রয়োজন।

পুজো তো সকলের জন্য। হুইলচেয়ার দেখে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় বুঝেছি সমাজে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সকলের কথা ভাবেন। কিন্তু সচেতনতার বড়ই অভাব। মণ্ডপ পরিকল্পনার সময়েই তো প্রবেশযোগ্যতার কথা মাথায় রাখার কথা। অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থার মতো হুইলচেয়ার ঢোকার জায়গাও বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের ফুটপাত, মেট্রো রেল হুইলচেয়ার নিয়ে চলার যোগ্য নয়। অথচ বড়রা একটু সচেতন হলেই আমার মেয়ের মতো বহু শিশুর জীবন মূল স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE