জলা বুজিয়ে এ ভাবেই নির্মাণ চলছে বলে অভিযোগ। নিজস্ব চিত্র
মাছ চাষের জলাশয়ে গজিয়ে উঠেছে হাজারখানেক ফ্ল্যাট ও বাড়ি। আইনের চোখে তা অবৈধ হলেও বেশির ভাগ নির্মাণেই মিলেছে পুরসভার অনুমোদন। বাইপাসের ধারে কলকাতা পুরসভার ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াবাদ এলাকায় বেশ কিছু কাল ধরেই সেই বেআইনি নির্মাণ চলছে। অথচ, নজরে পড়েনি পুলিশ, কাউন্সিলর বা পুর প্রশাসনের। এখন মুখ্যমন্ত্রীর নজর পড়তেই হুঁশ ফিরেছে তাদের। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস গিয়েছিলেন এলাকায়। এ বার ঢাল-তলোয়ার হাতে ‘মিশন নয়াবাদ’ নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন সকলে। বৃহস্পতিবার পুর ভবনে পুর কমিশনার খলিল আহমেদের ঘরে এক জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জলাভূমি বাঁচাতে নয়াবাদের রাস্তায় বসানো হবে সিসি ক্যামেরা। মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় দিনরাত টহল দেবে পুলিশ। ভাঙা হবে কয়েকটি বেআইনি নির্মাণও।
তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যতটা সহজ, কাজটা ততটাই কঠিন হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকায় গিয়ে শোনা গেল, পুকুর বা জলাভূমি বুজিয়ে নির্মাণ নতুন কোনও ঘটনা নয়। সেই বাম আমলে শুরু হয়েছিল। যা আরও বেড়েছে তৃণমূলের জমানায়। প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের মতে, জলাজমি বুজিয়ে নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই কড়া হাতে ব্যবস্থা নিলে সমস্যাটা এ জায়গায় যেত না।
পুরসভা সূত্রের খবর, নয়াবাদের ওই জায়গাটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের সমবায় সমিতির অধীনে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ত্রিগুণা সেন তার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওই এলাকায় ২৭ বছরের বাসিন্দা রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘‘বাম আমলে ওই সমিতির রাশ হাতবদল হতেই জমির হস্তান্তর নিয়ে সমস্যা বাড়ে। এক সময়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ জমিই বাইরের লোকের হাতে চলে গিয়েছে। অনেককে ভয় দেখিয়েও সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।’’ সেই শুরু। রথীন্দ্রনাথবাবু বলেন ‘‘শুধু ওই সমবায় সমিতি নয়, আশপাশের জলাজমিও ভরাট হয়েছে দেদার। আমরা শুধু দেখেই গিয়েছি।’’ পুলিশ বা পুর প্রতিনিধি— কেউ কিছু করেননি বলে অভিযোগ। আর এক বাসিন্দা রামকৃষ্ণ রায় একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওই যে লাইন দিয়ে বাড়ি দেখছেন, সবই জলাভূমির উপরে। কোনওটা তিনতলা, কোনওটা বা চারতলা।’’ সব ক’টি বাড়িই হয়েছে তাঁদের চোখের সামনে। বললেন, ‘‘লেখা ছিল, ‘বিল: মাছ চাষ’। তা হলে সেখানে বিল্ডিং হল কী করে?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সম্প্রতি এলাকায় গিয়েছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। প্রায় দু’ঘণ্টা ঘুরে দেখেন ওই এলাকা। ছিলেন কলকাতার পুর কমিশনার, ডিসি (পূর্ব), ভূমি সংস্কার এবং মৎস্য দফতরের অফিসারেরাও। সেখানে তাঁদের জানানো হয়, জাল নথি দিয়ে সব কিছু করা হয়েছে। তবে পুরসভা থেকে নির্মাণের অনুমোদনও পেয়েছেন কেউ কেউ। কী করে সম্ভব হল তা? উত্তর মেলেনি। তবে পুর কমিশনার খলিল আহমেদ বলেন, ‘‘বিল্ডিং দফতরের অনুমোদন কী ভাবে জোগাড় করা হল, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’’
একটি পুকুরপাড়ে গিয়ে মন্ত্রী ও অফিসারেরা দেখেন, একাধিক বাড়ি প্রায় ভেসে রয়েছে পুকুরের উপরে। যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে, তা পুকুরের একাংশ বুজিয়ে তৈরি হয়েছে। ওই এলাকার অন্তত ৪০ একর জলাজমিতে এ ভাবেই নির্মাণ হয়েছে বলে ধারণা পুর অফিসারদের। টাকার পরিমাণে কয়েকশো কোটি। যার কিছুটাও পুরসভা বা সরকারের ভাঁড়ারে আসেনি।
ওই এলাকার একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জানানো হয়েছিল বিষয়টি। কিন্তু কিছু হয়নি। তবে জলাভূমি বুজিয়ে নির্মাণের বিষয়টি যে সত্যি, তা স্বীকার করে নিয়ে অনন্যার জবাব, ‘‘আমি তো ২০১৫ সালে কাউন্সিলর হয়েছি। যা হওয়ার তার আগেই হয়েছে।’’ যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মৎস্য দফতর থেকে ‘নো অবজেকশন’ নিয়ে ভূমি সংস্কার দফতর থেকে চরিত্র বদলের কাগজ বার করা হয়েছে। অভিযোগ তার অনেকগুলিই জাল। তা দেখিয়েই পুরসভার বিল্ডিং দফতরের অনুমোদন মিলেছে। এলাকায় জোর গুঞ্জন, প্রশাসনের উপর মহলের মদত না থাকলে এ সব করা সম্ভব নয়। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের পরিদর্শনের পরে এ বার সব কিছু খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছে পুরসভা ও বাকি দুই দফতর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy