Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

এদের কাছেই টাকা চেয়েছিল ভর্তি-দাদারা, ফোন ফেরাল ওরাই

খবর সংগ্রহে বেরিয়ে বুধবার সকালে মোবাইল ফেলে এসেছিলাম আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি কলেজে। খেয়াল হল বিকেল চারটে নাগাদ। ওই নম্বরে ফোন করতেই কিশোর কণ্ঠ বলল, ‘‘দাদা, আমার নাম তমাল বণিক (নাম পরিবর্তিত)। কলেজে ফোনটা পেয়েছি। একটা মোটরবাইকের ওপর ছিল। কাল (বৃহস্পতিবার) কলেজে যাব। আপনি আসুন। দিয়ে দেব।’’

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৮ ০৪:০৭
Share: Save:

রাতে হাইওয়ের ধারে অপেক্ষা করছিল তিনটে মুখ। এক জন বলল, ‘‘মাকে গিয়ে বল, আলমারি থেকে ফোনটা বার করে দিতে।’’

তার পর হারানো ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘‘দাদা, এসো তোমাকে চা খাওয়াই।’’ চোখে জল এসে গিয়েছিল। এদের ওপর ভরসা না রেখে আমি কিনা রাতেই চলে এসেছি বাসন্তী হাইওয়ের কাছে। আমার ফোন আগলে রাখা তিন কিশোরের আসল কাহিনি তখনও তো শোনাই হয়নি।

খবর সংগ্রহে বেরিয়ে বুধবার সকালে মোবাইল ফেলে এসেছিলাম আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি কলেজে। খেয়াল হল বিকেল চারটে নাগাদ। ওই নম্বরে ফোন করতেই কিশোর কণ্ঠ বলল, ‘‘দাদা, আমার নাম তমাল বণিক (নাম পরিবর্তিত)। কলেজে ফোনটা পেয়েছি। একটা মোটরবাইকের ওপর ছিল। কাল (বৃহস্পতিবার) কলেজে যাব। আপনি আসুন। দিয়ে দেব।’’ কিন্তু দুশ্চিন্তা যায়নি। ফোনের ডেটা, ছবি নষ্ট হয়ে যাবে না তো? ফিরে পাব তো?

রাতেই চলে যাই বাসন্তী হাইওয়ে ঘেঁষা একটি মাঠের কাছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল তমালেরা। পৌঁছতেই আর এক কিশোর সুমন ঘোষকে (নাম পরিবর্তিত) ফোন আনতে বাড়ি পাঠাল তমাল। সুমন ফোন আনার পর ওরাই নিয়ে গেল চায়ের দোকানে। তমালের বাবা চালান সেটি। চা খেতে খেতে শুরু হল কথাবার্তা। সুমন বলল, ‘‘বহুক্ষণ ফোনটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। ভাবছিলাম, ফোনের মালিক নিশ্চয়ই আসবেন। কিন্তু অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরেও কেউ আসেননি। আমাদের খুব খিদে পেয়েছিল। কিন্তু ফোনটা ছে়ড়ে যেতে মন চাইছিল না। হাতও দিতে পারছিলাম না। যাঁর ফোন, তিনি যদি ফিরে এসে চোর ভাবেন!’’ এর পর বলল, ‘‘কিছু মনে কোরো না, তোমার ফোনে ছোট ঢিলও ছুড়েছিলাম।’’ কেন? ‘‘বোমা রাখা আছে কি না, দেখছিলাম। তার পরে কাছে যাই।’’ রবি সামন্ত (নাম পরিবর্তিত) নামে আর এক কিশোর বলল, ‘‘সুমনকে বললাম, ফোনটা নিয়ে বাড়ি চল। যাঁর ফোন, তিনি ঠিক ফোন করবেন। এখানে রেখে গেলে এখানকার কেউ বিক্রি করে দেবে।’’

আরও পড়ুন:

সাড়ে ৬ দিতে বলেছিল

‘এখানকার কেউ’ মানে? সুমন বলে, ‘‘ওরা ভাল হতে পারে না। বিএ জেনারেলে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম। আমার থেকে সাড়ে ছ’ হাজার টাকা চেয়েছে। এরা যখন টাকা চাইতে পারে, ফোন পেলে তো বেচে দেবেই।’’ সামান্য থেমে আবার বলে, ‘‘এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। বাবা বলে দিয়েছেন, দিতে পারবেন না। শুধু ভর্তির সাড়ে তিন হাজার টাকা জোগাড় করতে পেরেছেন।’’

চা বানাতে বানাতে তমালের বাবা বললেন, ‘‘ওর মা আর আমি মিলে এই ছোট দোকানটা চালাই। এ বার আর ছেলেটাকে পড়ানো হবে না।’’ সুমনের বাবা অস্ত্রোপচারের পরে শয্যাশায়ী। দাদা সাফাইকর্মী। তাঁর রোজগারেই সংসার চলে। আরও এক ভাই স্কুলে পড়ে। সুমন বলে, ‘‘যদি কলেজে বলে দিতে পারেন, দেখুন না। টাকা না-দিলে ভর্তি হতে দেবে না। আমরা টাকা দিতে পারব না।’’

জেনে ভাল লাগছে বৃহস্পতিবার তিন জনেই কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে, অধ্যক্ষ এবং ছাত্র সংসদের একাংশের সহায়তায়। বাড়তি টাকা দিতে হয়নি। অধ্যক্ষ এ-ও বলেছেন, ‘‘আমায় অভিযোগ জানাক। দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’’ আবার চোখে জল এল। ওরা ভর্তি হতে পেরেছে জেনে। সংসারের অনটন, ভর্তির টাকার চাপ সত্ত্বেও যারা মাথা উঁচু রাখতে জানে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE