Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Kolkata Korcha

কলকাতার কড়চা: পঞ্চাশ বছরে সল্টলেক

গান-কবিতা-নাটক-সিনেমার উচ্ছ্বাসে সামান্য সেই সল্টলেককে ঘিরেই এখন কলকাতার বুকে সঞ্চারিত ঈর্ষার মেঘ।

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

সারি সারি সব বাড়ি যেন সারবাঁধা সব সৈন্য/ সব এক রং, সব এক ধাঁচ, তুমি কোথায় থাক অনন্য...’ এ-বি-সি ব্লকের গোলকধাঁধার এই বিভ্রান্তি কি বাংলা গানে সল্টলেকের স্বাক্ষর? হলেও তা নিয়ে শব্দ খরচ হয়নি তেমন। যেমন, সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি তালুকে টেকনোপলিস বা ইনফিনিটি বিল্ডিং দেখে কেউ লেখেননি ‘সমস্ত ক্ষণ রক্তে জ্বলে বণিকসভ্যতার শূন্য মরুভূমি।’

গান-কবিতা-নাটক-সিনেমার উচ্ছ্বাসে সামান্য সেই সল্টলেককে ঘিরেই এখন কলকাতার বুকে সঞ্চারিত ঈর্ষার মেঘ। সিটি সেন্টারের খোলামেলা স্থাপত্যে তারুণ্যের বাতাস আকছার গঙ্গার হাওয়াকেও টেক্কা দিয়েছে। ময়দানের ফুটবল থেকে বইমেলা, সবই সল্টলেকের দখলে। নবান্নের জন্মের ঢের আগেই রাজ্য প্রশাসন কলকাতার পুবমুখো। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের চাবির গোছা সল্টলেক আঁচলে বেঁধেছে। করোনাকাল শুরু না-হলে হয়তো ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলেও সড়গড় হয়ে যেত সে।

ক্রমশ স্বনির্ভর সম্পূর্ণ বিধাননগর উপনগরীটিকে অবশ্য টিটকিরিও শুনতে হয়েছে। এশিয়ার তাবড় মেছো ভেড়ি ভরাট করা নোনা জমির জাজিম যে কোনও দিন বসে যেতে পারে! ১৯৮৪। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়ামে (ছবিতে যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গন) প্রথম কিক-অফে নেহরু গোল্ড কাপের আসরে চিন-ভারতের টক্করে সাক্ষী দেশবাসী। তখনও সাবালক নয় সল্টলেক। জনসংখ্যার চাপে সবুজঘেরা নাগরিক আবহের চাহিদা মেটাতে বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্নের প্রকল্পটির সূচনা কিন্তু ১৯৬২-তে। ভেড়ির বুকে গঙ্গামাটি ফেলল যুগোস্লাভ যন্ত্র। নাগরিক যাপন শুরু মোটামুটি অর্ধ শতক আগে। অতিমারির গ্রাসে চাপা পড়েছে উদ্‌যাপন। আজকের এবি ব্লকে প্রথম বসতবাটির গৃহপ্রবেশ ৯ মার্চ, ১৯৭০।

তখনও অকিঞ্চিৎকর উল্টোডাঙা হল্ট স্টেশনে ওয়াগন ব্রেকারদের দাপট। বাস ধরতে কাশবন ঠেলে হেঁটে হাতিবাগান বা গৌরীবাড়ি যেতে হত। লটারিতে লিজ়প্রাপ্ত জমির কাঠা সাড়ে তিন হাজার টাকা। জনতার প্রাথমিক অনীহায় তা কমে অর্ধেক হয়। কপাল ঠুকে বাড়ি উঠিয়েও সেচ দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। ভেড়ির জমি থেকে উৎখাত, লাগোয়া মহিষবাথান গ্রামে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ক’জন মৎস্যজীবীই ভরসা দিলেন। জিতেনবাবুর পুত্র, সে-দিন সদ্যতরুণ অশোকের মনে আছে, ওঁরা প্রায়ই উল্টোডাঙা থেকে বাজার করে দিতেন।

হ্যারিকেনের আলো। ইঁদারা-টিপকলের জল। সাপের ভয়। মশার আড়ত। তবু ছবিটা পাল্টাতে থাকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনের পরে। এসি-বসানো দোতলা খোড়ো বাড়িতে ছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৯০-এর দশকে সেখানেই থাকতে শুরু করেন জ্যোতি বসু। শেয়ালের ডাকে তাঁর ঘুম নষ্ট হওয়ার কাহিনিও সল্টলেকের লোকগাথার অংশ।

আমপানে বহু গাছ পড়ে গেলেও, লকডাউনে পাখিরা ফিরছে বলে খুশি বাসিন্দারা। সল্টলেকে ইতিহাসের রোমাঞ্চ নেই, শুধুই পরিবর্তনের স্রোত। তবু শিকড়ের সংযোগ অটুট এখনও। প্রথম গৃহকর্তা জিতেনবাবু খুলনার মূলঘর গ্রাম থেকে দেশান্তরী। সল্টলেকের আদি বাড়ি মূলঘর নাম বহন করছে।

ন’দিদি

১৮৭৬, সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছে এক উপন্যাস। এক সম্ভ্রান্ত বংশীয়ার লেখা, জানাল সাধারণী। ক্যালকাটা রিভিউ চিহ্নিত করল বাংলা সাহিত্যের যোগ্যতম সৃষ্টিগুলির একটি হিসেবে। দীপ-নির্ব্বাণ নামে সেই উপন্যাসের লেখক স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৬-১৯৩২)। এগারোটি উপন্যাসের রচয়িতা স্বর্ণকুমারী (ছবিতে) কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক রচনাতেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। পিয়ানোয় সুর তুলছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সেই পরিমণ্ডলেই হয়তো সঙ্গীতেও তাঁর অভিিনবেশ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা, রবীন্দ্রনাথের ন’দিদি বাঙালি নারীকে স্বাদ দিয়েছিলেন বাহিরমহলের— ভারতী পত্রিকা সম্পাদনা, কংগ্রেস অধিবেশনে যোগদান, থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সভাপতিত্ব-সহ নানা কাজ তার সাক্ষী। নারী-জীবনের উন্নতিকল্পে গড়েছিলেন সখি সমিতি, জানিয়েছেন, এর লক্ষ্য ‘মেয়েতে মেয়েতে আলাপ-পরিচয়, দেখাশোনা, মেলামেশা, স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তার ও উন্নতির চেষ্টা।’ ২৮ অগস্ট দিনটি কয়েক বছর ধরেই লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করছে জেন্ডার কালেক্টিভ ‘আসানসোল উড়ান’। এ বছরও তাদের আয়োজনে হয়ে গেল স্বর্ণকুমারী ও এই সময় শীর্ষক অনলাইন আলোচনাসভা। কলকাতা কি ভুলে গেল তাঁকে?

শহরের ইতিহাস

কলকাতার তথাকথিত জন্মদিন ও জোব চার্নক নিয়ে তর্ক যত, অঞ্চল হিসেবে কলকাতার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হয় না তেমন। সেই ভাবনা থেকেই সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইতিহাস বিভাগ ও আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় রত কলকাতার সংস্থা ‘গ্রাম-জনপদ’-এর যৌথ উদ্যোগ ওয়েব-আলোচনাসভা ‘উনিশ শতকে কলকাতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’। চলবে ২-৪ সেপ্টেম্বর, তিন দিন ধরে। কলকাতার ইতিহাস গবেষক ও বিশিষ্ট চিকিৎসক দেবাশিস বসু বলবেন এই শহরের ইতিহাসের উপাদান নিয়ে, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থ দত্ত বলবেন শহরের পরিকল্পনা নিয়ে। কলকাতার মসজিদ-স্থাপত্য নিয়ে বলবেন ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, শহরের পারিবারিক কুলদেবতাদের নিয়ে অর্ণব নাগ। উনিশ শতকের ‘নবজাগরিত’ শহরের কয়েকটি পরিবারের ‘কিস্‌সা’ শোনাবেন শেখর ভৌমিক, সমাপ্তি ভাষণে ১৮৩০-এর কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড ম্যাকফারলানকে নিয়ে বলবেন নিখিল সুর।

স্মরণে নজরুল

১১ জ্যৈষ্ঠকে মনে থাকে, ২৯ অগস্ট মনে থাকে না তত। প্রয়াণদিনে কাজি নজরুল ইসলামকে সনিষ্ঠ স্মরণ করে আসছে উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি। করোনাবন্দি জীবনে এ বছর তাদের ইউটিউব চ্যানেল ‘জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভ’-এ ২৯ অগস্ট হল দিনভর অনুষ্ঠান ‘ওগো আঁধারের সাথি’। ছিল মুজফ্ফর আহমেদ-নজরুল সম্পর্ক, নেতাজি-নজরুল কথা, শ্যামাপ্রসাদকে লেখা নজরুলের চিঠি নিয়ে আলোচনা, এবং গান। কলকাতার মীরাতুন নাহার, অনুপ মতিলাল, স্বপন সোমের সঙ্গে ছিলেন ত্রিপুরার মায়া রায়, বাংলাদেশের খায়রুল আনাম শাকিল, ইয়াকুব আলী খান, কল্পনা আনাম, বিজনচন্দ্র মিস্ত্রী, ইকরাম আহমেদ প্রমুখ। সমগ্র অনুষ্ঠানটি নজরুল-গবেষক ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের স্মৃতিতে নিবেদিত।

আপনজন

‘‘তখন নিম অন্নপূর্ণা-র জন্যে কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না, তাঁকে দেখামাত্রই পছন্দ হয়ে গেল। শুটিং শুরু হতে অসম্ভব ভাল লাগল ওঁর কাজ। পরের ছবি গৃহযুদ্ধ-তেও নিলাম। দু’টি ছবিতেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন।’’ মণিদীপা রায়কে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিষাদ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের স্বরে, ‘‘যেমন অসামান্য অভিনেত্রী, তেমনই অসামান্য মানুষ। তখন অর্থাভাব, কত কষ্ট হয়েছিল কাজ করতে মণিদীপার, অথচ চমৎকার মিশে গিয়েছিলেন ইউনিটের মানুষজনের সঙ্গে। আমার ছবির পরেও ওঁকে কেউ কাজে লাগাল না, বাংলা ছবির দুর্ভাগ্য!’’ ১৯৪২ সালে কটকে জন্ম, শ্যামবাজারের বনেদি পরিবারের মণিদীপার নাচই ছিল ধ্যানজ্ঞান। বাবা নন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন হাইকোর্টের সলিসিটর, মা সাহিত্যিক মীরা দেবী, মামা চিত্রশিল্পী অশোক মুখোপাধ্যায়। আজন্ম শৈল্পিক বাতাবরণে বড় হয়ে ওঠা মণিদীপার জীবনে কখন যেন জড়িয়ে গেল অভিনয়। তবে নাচ ছাড়েননি, নিজের নাচের স্কুল ‘নিক্বণ’ চলছিলও, পা বাদ সাধল তাই বন্ধ হল এক সময়ে। থিয়েটারের মানুষজনের বিপদে পাশে দাঁড়াতেন, বলতেন, ‘‘আমি থিয়েটারের মানুষ, থিয়েটারকে না বাঁচালে চলে!’’ নক্ষত্র, প্রতিকৃতি, চেতনা, থিয়েটার কমিউন, সংলাপ কোলকাতা, সমীক্ষণ, কুশীলব, ভার্গব, শোহন, প্রয়াস, প্রত্যয়— এমন আরও নাট্যদলকে অভিনয়ে ঋদ্ধ করে, চলে গেলেন হঠাৎই, গত ১৮ অগস্ট। মণিদীপার ভার্চুয়াল স্মরণিকা প্রকাশিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্মদিনে। সঙ্গের ছবিটি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

হাত বাড়িয়ে

২০ মে আমপানে ধ্বস্ত হয়েছিল বাংলা। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল আজও তার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায়। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুণের ইন্দিরা গাঁধী ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট রিসার্চের তিন বাঙালি ছাত্রী। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রছাত্রীদের ডিজিটাল পত্রিকা ইলিক্সির বৈদ্যুতিন পত্রিকার পরিসরে একটি পরিচিত নাম, হাত বাড়িয়েছে এই পত্রিকার নেপথ্যচারীরাও। সম্মিলিত প্রয়াসে সম্প্রতি প্রকাশিত হল বিশেষ সংখ্যা ইলিক্সির-সংকল্প। বাংলা-হিন্দি-ইংরাজি ত্রিভাষিক পত্রিকায় লিখেছেন কলকাতার শিক্ষাবিদ থেকে প্রথম সারির গদ্যকাররা। আছে মহেশ দত্তানি, গৌতম হালদার-সহ বিশিষ্ট গায়ক-শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, দুই বাংলার কবিতা। পত্রিকা বিক্রির অর্থ যাবে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে, তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে। বিনিময়মূল্য মাত্র পঞ্চাশ, কিন্তু পাশে দাঁড়ানোর তরুণ প্রয়াসটি অমূল্য।

জীবনের ছবি

লকডাউন বা আনলক-পর্বে চিত্রকলা ও আলোকচিত্রের প্রদর্শনী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখতে হচ্ছে অনলাইন। কিন্তু ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার যে আনন্দ ও রহস্যঘন অভিজ্ঞতা, তা কি পাচ্ছেন চিত্রবেত্তা দর্শক? সম্ভবত তা বুঝেই, করোনা-আবহেও যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিমা গ্যালারিতে চলছে সমসময়ের ছ’জন শিল্পীর আঁকা ৫৬টি চিত্রের প্রদর্শনী ‘মিক্সড মিডিয়া’। অতিমারি আমাদের দাঁড় করিয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে এত দিন ক্রমাগত এড়িয়ে-যাওয়া প্রশ্নগুলোর সামনে। ইনা কউর, কিংশুক সরকার, রশ্মি বাগচী সরকার, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, সোহম গুপ্ত ও বিশাল ভান্ডের ছবিতে তারই প্রতিফলন— মানুষের জীবনের সাধারণত্ব, কিংবা আপাত-শান্ত প্রকৃতির আড়ালে হঠাৎ-হিংস্রতার চোরা স্রোত। অ্যাক্রিলিক পেন্ট থেকে সেলাই, অ্যাপ্লিক থেকে মাইক্রোটিপ কলম, এমব্রয়ডারি থেকে জলরং, গ্রাফাইট ড্রয়িং, আর্কাইভাল পিগমেন্ট প্রিন্ট, মশারির নেট, টি-ব্যাগ, টার্কিশ ফেব্রিক, হাতে তৈরি জাপানি কাগজ— শিল্পীদের বিবিধ মাধ্যমের অনবদ্য ব্যবহার দেখতে পাবেন দর্শক। প্রদর্শনী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, রোজ সকাল ১১টা থেকে সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

একাই ১০০

ঢাকার নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে ম্যাটিনি শো দেখতে যেতেন দীনেশ গুপ্তের সাইকেলের কেরিয়ারে বসে। রাইটার্স বিল্ডিংসে হামলার জেরে দীনেশের যে দিন ফাঁসি হয়, সাম্যময় অর্থাৎ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এগারো। মুক্তির চেতনা পরে তাঁকে চালিত করেছিল ‘অনুশীলন সমিতি’ হয়ে আরএসপি-র ছাত্র সংগঠনে, আরও পরে কংগ্রেস সরকারের নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বা শিল্পী-কলাকুশলীদের স্বার্থে অভিনেতৃ সঙ্ঘে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। কিন্তু ২৬ অগস্ট যাঁর শতবর্ষ শুরু হল, তাঁকে কি বাঙালি চিনেছে? পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় বসু পরিবার এবং পরে সাড়ে চুয়াত্তর ছবি দিয়ে জয়যাত্রা শুরু, এক দশকের মধ্যে খ্যাতির বিচারে তিনিই কার্যত বাংলা কমেডির উত্তমকুমার। তাঁর নাম দিয়ে ছবি হচ্ছে, চ্যাপলিনের এই ভাগ্য হয়নি, উত্তমেরও নয়। হয়তো সেটাই কাল হল, ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে হাসির বাইরে বেরোতে দিল না। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে বা অমৃতকুম্ভের সন্ধানে ছবিতে তাঁর সিরিয়াস অভিনয় কি বাঙালি মনে রেখেছে? কেরিয়ারের শুরুতে বিমল রায়ের তথাপি ছবিতে ভানুর সহ-অভিনেতা ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। কিন্তু ঋত্বিক বা সত্যজিতের ছবিতে সে দিনের তুলসী, জহর, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়রা থাকলেও তিনি নেই। সব চরিত্র ছাপিয়ে ‘ভানু’ হয়ে উঠছিলেন বলে? শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। সুচন্দ্রা ভানিয়ার প্রযোজনায় ‘জাস্ট স্টুডিয়ো’-র তৈরি তথ্যচিত্র ভানু একাই একশো তাঁর শততম জন্মদিনে ইউটিউবে এল, সেখানে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, লিলি চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, গৌতম হালদার, কাঞ্চন মল্লিক-সহ সকলের মুগ্ধতা, পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বা কন্যা বাসবী ঘটকের স্মৃতিলেখ। ইস্টবেঙ্গল ভক্তদের ফেসবুক পেজেও ভানুকে নিয়ে স্মৃতিময় শ্রদ্ধার্ঘ্য। সব কিছু ছাপিয়ে তবু জেগে থাকে প্রশ্ন, তাঁর মতো সমাজ ও রাজনীতি-সচেতন অথচ ‘ছাঁচবন্দি’ শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন কবে হবে? ছবিতে উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবির উৎসব

‘‘ন্যাশনালিজ়ম বা পেট্রিয়টিজ়ম-এর চেয়েও বড় হচ্ছে মানবিকতা, সেই মানবিকতার যখন অবমাননা হচ্ছে কোথাও, তখন প্রতিবাদে সরব হও।’’ গত নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলা অপর্ণা সেনের এই কথাগুলি তাঁর ছবিতেও সত্য হয়ে ওঠে। আজ সন্ধ্যা ৭টায় অনলাইন ওয়েবিনারে নিজের ছবির শিল্পভাবনা নিয়ে বলবেন অপর্ণা সেন, তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে বিশিষ্ট কন্নড় চলচ্চিত্র-আলোচক ও লেখক এম কে রাঘবেন্দ্র। আয়োজনে ‘ফিপরেস্কি’, ৫০টি দেশের চলচ্চিত্র-সমালোচকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন। এঁদের সঙ্গে যৌথ ভাবে আজ থেকে অনলাইন ‘উইমেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ শুরু করছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া (এফএফএসআই), সঙ্গে অসম উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, চলবে

৬ সেপ্টেম্বর অবধি। আই অ্যাম বনি, থ্রি সিস্টার্স, দ্য ফ্লাওয়ার্স অ্যান্ড দ্য জেমস্টোনস, দোলাচল-এর মতো একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র ও ছোট ছবির সঙ্গে দেখানো হচ্ছে তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র— রীমা বোরার বকুল, ববি শর্মা বড়ুয়ার সোনার বরণ পাখি ও শতরূপা সান্যালের অন্য অপালা। এফএফএসআই-এর ফেসবুক পেজে দেওয়া লিংকের মাধ্যমে দেখা যাবে সব ছবি।

স্মরণে, মননে

ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মরণে প্রতি বছর তাঁর নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে ‘প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট’। বিগত বছরগুলিতে সেখানে বলেছেন ফ্ল্যাভিয়া অ্যাগনেস থেকে নিবেদিতা মেনন, পি সাইনাথ, কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ড, রবীশ কুমাররা। এ বার সপ্তম বছরের বক্তা, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসবিদ ও সমাজকর্মী নব দত্ত। ১৯৮৯ সাল থেকে শ্রম, পরিবেশ ও উন্নয়ন নিয়ে কর্মরত সোশ্যাল অ্যাকশন গ্রুপ ‘নাগরিক অধিকার মঞ্চ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি, শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কাজ করছেন তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। বলবেন ‘শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে রূপান্তরকামী মানুষের অস্তিত্ব ও অবস্থান’ নিয়ে। শ্রমিক আন্দোলন বা শ্রমিক ইউনিয়নের সুদীর্ঘ ও বহুচর্চিত ইতিহাসে রূপান্তরকামী মানুষদের শ্রমিক হিসেবে ভূমিকার উল্লেখ নেই, তা যেন থেকে গিয়েছে শ্রম বিষয়ক চর্চার নিরীক্ষার আড়ালেই। এই শূন্যস্থান পূরণেই শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও তাত্ত্বিকদের সঙ্গে রূপান্তরকামী শ্রমিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের সংযোগ ঘটাচ্ছে প্রত্যয়। এ বছরের বক্তৃতাও সেই সংলাপসূত্র ধরেই। করোনা-আবহে এ বারের বক্তৃতা আয়োজিত হচ্ছে অনলাইন, আজ রাত বারোটা পর্যন্ত তা শোনা যাবে প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট-এর ইউটিউব চ্যানেলে।

সমাজবন্ধু

অসময়ে চলে গিয়েছিলেন সুব্রত মৈত্র (১৯৫৬-২০১৬)। তারকাদের আরোগ্য বিধানের সঙ্গে অসহায়দেরও পাশে সতত দাঁড়িয়েছেন যশস্বী এই চিকিৎসক। ৮ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন, বেলভিউ ক্লিনিকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেডিকাল কনসর্টিয়াম এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আগামী নির্মাণ’ এই উপলক্ষে আন্তর্জালে আয়োজন করেছে চতুর্থ সুব্রত মৈত্র স্মারক বক্তৃতার। স্বাগত ভাষণে থাকবেন উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ভাইস চেয়ারপার্সন মমতা রায়। কনখল রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী দয়াধিপানন্দ ডাক্তারবাবুর স্মৃতিচারণ করবেন, সেই সঙ্গে বলবেন স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে স্বার্থহীনতা ও দায়িত্বের যোগাযোগ নিয়েও। ‘স্বাস্থ্য পরিষেবায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা’ নিয়ে বলবেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। থাকবেন কনসর্টিয়ামের তরফে চিকিৎসকরা, সমাজসেবী দিব্যালোক রায়চৌধুরী, ডা. মৈত্রের স্ত্রী চৈতালী মৈত্র-সহ বিশিষ্টজনেরা। প্রতি বছর এই আয়োজনে দুঃস্থ ও মেধাবী পড়ুয়াদের বৃত্তি দেওয়া হয়, এ বছরও তা ঘোষণা হবে। সমাজবন্ধু মানুষটির স্মরণে এই অনুষ্ঠান ৪ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৪.৪৫ থেকে।

‘পরবর্তী স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে’

মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি বা এসকালেটরে পা রাখলে চেনা গানের কলি কানে ভেসে আসবেই। প্রবল ভিড়ে ঠেলাঠেলি-রাগারাগি এমনকি প্রায় হাতাহাতির সঙ্গে সে-ও ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গোছের কিছু। এক-একটা গান কিছু দিন টানা চলে, সকলের অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতসারে ঠোঁটস্থ হয়ে গেলে সেটা পাল্টে নতুন কিছু, তার পর ফের সেই নিয়ম। মেট্রোতুতো ভাই-বেরাদরদের আড্ডার বড় খোরাক প্ল্যাটফর্মে টিভির ওই সব গান, কিংবা রুপোলি পর্দার নায়কদের সতর্কবাণী, আত্মহত্যা ঠেকানোর পরামর্শ, জিনিস কিনে ঠকে গেলে কী করতে হবে তার নিদান ইত্যাদি। একঘেয়ে অফিসযাত্রায় যেটুকু বিনোদন খুঁজে নেওয়া যায় আর কী!

সে সব কি আবার ফিরছে? এত দিন ইতিউতি খবর মিলছিল, সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে মেট্রোর ট্রায়াল রান চলছে, ‘নিউ নর্মাল’-এর দস্তুর মেনে স্টেশনগুলো নবরূপে সেজে উঠছে। ‘আনলক-৪’ পর্বের প্রাক্কালে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের উদ্যোগ দেখে সেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে। ইতিমধ্যেই আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে দেশ জুড়ে মেট্রো চলাচলের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তার আগের দিনই এ ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব।

রোজকার পরিচিত যন্ত্রণা ছাড়াও জীবন যে চলে না। যে নিত্যযাত্রীদের কাছে মেট্রোর ভিড় ছিল ভয়ানক আতঙ্কের, যাঁরা মনে করতেন ‘নেহাত উপায় নেই তাই রোজ চড়ছি’, তাঁরাও আজ বলছেন, ‘কবে যে আবার মেট্রোয় চড়ব!’ আনলক-৪’এর গাইডলাইন তাঁদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ সঞ্চার করেছে, সন্দেহ নেই।

এত দিন মেট্রো রেলওয়ে কলকাতা-র ফেসবুক পেজ-ই ছিল চিরপরিচিতের সঙ্গে সংযোগের উপায়। দিনকয়েক আগে এক ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছিল, বেলগাছিয়া সাবস্টেশনের ব্যাটারি রুম পরিষ্কার হচ্ছে, সাফসুতরো হচ্ছে সমস্ত সার্ভিস ব্রেক। চলছে হরেক উদ্যোগ, অনুষ্ঠানও। স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন করলেন মেট্রো রেলের জেনারেল ম্যানেজার মনোজ জোশী। সেই উপলক্ষে ১০ থেকে ১৬ অগস্ট ‘পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ’ও পালন করেছেন মেট্রো কর্মীরা। অনুষ্ঠানের মঞ্চে ঘোষিত হল মেট্রো রেলের তৈরি ‘স্মার্ট কার্ড রিচার্জ’ অ্যাপ। পরিষেবা আবার চালু হলে কাউন্টারে ভিড় এড়াতেই এই অনলাইন টাকা ভরানোর ব্যবস্থা। অতিমারি পরিস্থিতি নিয়েও সচেতন মেট্রো কর্তৃপক্ষ— ১৫ অগস্ট তপন সিংহ মেমোরিয়াল হাসপাতালে করোনা-যোদ্ধাদেরও সম্মান জানিয়েছেন পদস্থ আধিকারিক ও অন্যরা। এ বার হয়তো ফের যাত্রী ও যানের কাছাকাছি আসার পালা।

তবে এখনও অপেক্ষার প্রহর গোনা। মেট্রো চালু হলেও চেনা কোলাহল শীঘ্র ফিরবে না। লম্বা লাইনের বিরক্তি, টোকেন নিয়ে বিভ্রান্তি, স্মার্ট কার্ডের হঠাৎ-অচলতা, কামরার মধ্যে ভুল বানানে লেখা নির্দেশিকার অস্বস্তির মধ্যেও যে নাগরিক সুখ লুকিয়ে ছিল, তা দেখা যাবে না। কিন্তু রোজকার চেনা গলাটা তো শোনা যাবে: ‘পরবর্তী স্টেশন... প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে...’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE