ভূকম্পে সবচেয়ে ক্ষতি হতে পারে নিউ টাউন-রাজারহাট এলাকার বহুতলগুলির। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
‘জেড প্লাস’ ক্যাটেগরির বেড়াজাল টপকে হামলাকারীরা ঢুকতে পারবে না ঠিকই, কিন্তু কলকাতার মাটি কেঁপে উঠলে বিপদ ঘনাতে পারে কালীঘাটে! এমনই বলছে কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক ও খড়্গপুর আইআইটি-র রিপোর্ট।
কলকাতায় ভূমিকম্প হলে কোন কোন এলাকা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা জানতে আইআইটি-র ভূতত্ত্ববিদদের দিয়ে সমীক্ষা করিয়েছিল ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক। তার রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এলাকা কিন্তু বিপদ-বলয়ের মধ্যেই রয়েছে। তবে ভূকম্পে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রাজারহাট-নিউ টাউন এলাকা। এ শহরের মাটি কেঁপে উঠলে শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তিও অক্ষত থাকবে না বলেই আশঙ্কা ভূবিজ্ঞানীদের।
ভূমিকম্প হলে কলকাতার কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে সমীক্ষা করেছেন খড়্গপুর আইআইটি-র ভূতত্ত্ব ও ভূপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথের নেতৃত্বে থাকা এক দল গবেষক। সেই প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, শিবপুর আইআইইএসটি এবং রাজ্যের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি পর্ষদও। ভূকম্প হলে এ দেশে কোন এলাকায় তার কতটা প্রভাব পড়তে পারে, সে ব্যাপারে আগে ‘ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস’-এর একটি মানচিত্র অনুসরণ করে চলা হত। তাতে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে ‘জোন টু’ (অতি মৃদু মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা যেখানে) থেকে ‘জোন ফাইভ’ (অতি প্রবল মাত্রার ভূকম্পের আশঙ্কা যেখানে) পর্যন্ত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। কিন্তু ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ভূপ্রাকৃতিক গড়ন এবং নগরায়ণ যে ভাবে বদলেছে, তাতে ভূমিকম্পের বিপদ ঠিক মতো আঁচ করতে হলে কোনও শহরকে কয়েকটি ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে সমীক্ষা করা উচিত। বিশেষ করে, কলকাতার মতো ব-দ্বীপের উপরে গড়ে ওঠা শহরের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। দিল্লির ক্ষেত্রেও এই সমীক্ষা হয়েছে।
গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
ভূকম্পে মহানগর বা দক্ষিণবঙ্গের কেঁপে ওঠা বিরল নয়। যার সর্বশেষ নজির মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হুগলির মাটির নীচে তৈরি হওয়া ভূমিকম্প (রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫)। তবে তাতে কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু কলকাতায় ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে ধারণা ভূবিজ্ঞানীদের। ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় পাত ক্রমশ ইউরেশীয় পাতের তলায় ঢুকছে। যার ফলে হিমালয় পার্বত্য এলাকা ভূকম্পপ্রবণ। সেই সঙ্গে ভূকম্পের আশঙ্কা রয়েছে এই এলাকাতেও। তাঁরা জানিয়েছেন, কলকাতার ভূপৃষ্ঠের সাড়ে চার কিলোমিটার নীচ দিয়ে একটি চ্যুতি রয়েছে, যার নাম ‘ময়মনসিংহ-কলকাতা হিঞ্জ’ বা ‘ইওসিন হিঞ্জ’। সেখানে যা শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, তা থেকে যে কোনও দিন রিখটার স্কেলে ৬.৫ মাত্রার ভূকম্প হতে পারে। খড়্গপুর আইআইটি-র ভূতত্ত্বের অধ্যাপক শঙ্করকুমারবাবু বলছেন, মঙ্গলবারের ভূমিকম্প হয়েছে হুগলির নীচে থাকা গড়ময়না-খণ্ডঘোষ নামে একটি চ্যুতিতে। তবে কলকাতার বিপদ আরও বাড়াচ্ছে মাটির নীচে থাকা পলির স্তর। এক ভূবিজ্ঞানীর মতে, ‘‘ভূগর্ভের কম্পন পলিমাটির ভিতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে উপরের দিকে উঠবে। পলিমাটির ভিতরে যত বেশি পাক খাবে, উপরের স্তরে কম্পনের মাত্রা তত বাড়বে।’’
আরও পড়ুন: অফিস-আবাসনে ভয় ‘বহিরাগত’ মশাই
ঠিক যেমন রাজারহাট-নিউ টাউনের বিপদ বাড়াচ্ছে জলাভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা বহুতল। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ওই সমস্ত এলাকার ভূস্তরে কম্পন হলে জল উঠে এসে মাটিকে নরম করে দেবে। কাদামাটি নরম হয়ে গিয়ে বহুতলের ভিত আলগা করে দেবে। তার ফলেই বাড়িগুলি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাটি জোরে কেঁপে উঠলে মধ্য এবং উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িগুলিতেও বিপর্যয় ঘটতে পারে। শুধু তা-ই নয়, কলকাতায় এখন আকাশছোঁয়া বাড়িও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলি কি ‘বিল্ডিং কো়ড’ মেনে তৈরি হচ্ছে? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক গুপিনাথ ভাণ্ডারী বলছেন, বিল্ডিং কোডে কলকাতা সার্বিক ভাবে ‘জোন থ্রি’ এবং ‘জোন ফোর’-এর মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘জোন ফোর’ ধরেই নকশা তৈরি করা হয়। তবে কলকাতার আঞ্চলিক সমীক্ষার পরে দাবি উঠেছিল, বিল্ডিং কোডে পরিবর্তন করার। তা এখনও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু যে বাড়িগুলি তৈরি হয়ে গিয়েছে, সেগুলিকেও ভূকম্প-প্রতিরোধী করে তোলার প্রযুক্তি রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy