উৎসব: পাত পেড়ে খাওয়ার স্মৃতি। ফাইল চিত্র
দুপুরে শহরের এক নামী বাঙালি রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া। আর রাতে ক্লাবে বাংলা বৈঠকী গানের অনুষ্ঠান সহযোগে আড্ডা, পানভোজন। পয়লা বৈশাখের সারা দিনের ছকটা আগেভাগেই কষা হয়ে গিয়েছে। এ বার দিনটা যেহেতু রবিবার, তাই সুবিধাও বেশি। ছেলে-বৌমার জোরাজুরিতে যাওয়ার ব্যাপারে সায়ও দিয়েছেন আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা। ব্যাপারটা যে তাঁর খুব খারাপ লাগবে তাও নয়। তবু পিছন ফিরে তাকালে হাল্কা মন খারাপটাও ঠেকিয়ে রাখতে পারছেন না। ভবানীপুরের দীপ্তি মজুমদার শনিবার বললেন, ‘‘আগে পয়লা বৈশাখ মানে ছিল বাড়ির উৎসব। আত্মীয়স্বজনের আসা, খাওয়াদাওয়া। এখন আর আসা নেই, সবটাই যাওয়া। বাইরে যাওয়া।’’
পাড়ায় পাড়ায় প্রভাত ফেরির সংখ্যা কমেছে। নতুন জামা পরে বাবা-মায়ের হাত ধরে হালখাতা করতে যাওয়া অতীত। বছরের প্রথম দিনটাকে ঘিরে সামাজিকতা, আত্মীয়তার পুরনো ছবিটাও ফিকে। পয়লা বৈশাখ এখনও পুরোদস্তুর শাড়ি-পাঞ্জাবির সাজে বাঙালির উদ্যাপনের দিন হলেও তার ধাঁচটা বদলে গিয়েছে। বেহালার অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় পুরনো দিনের কথা বলতে গিয়ে নড়েচড়ে বসেন। ‘‘খুব বেশি বছর আগের কথা তো নয়। পাড়ার দোকানপাট রাতারাতি সেজে উঠত। টাকাপয়সার লেনদেন বড় ছিল না, আসল কথা হল আপ্যায়ন। ছোটদের চোখ আটকে থাকত মিষ্টির প্যাকেট আর ঠান্ডা পানীয়ের বোতলের দিকে। বছরের অন্য দিনে ঠান্ডা পানীয় খাওয়ার সুযোগ বরাতে বড় একটা জুটত না। আমার ছেলেকে হালখাতায় নিয়ে গিয়েছি। আমার নাতি-নাতনিদের এ সব বললে ওরা হাসবে।’’
দমদমের সুপ্তি সরকার বললেন, ‘‘পুরনো অভ্যাসে আমি এখনও এই দিনটায় আত্মীয়দের ফোন করি। বাড়িতে ভালমন্দ রান্নাবান্না করি। ছেলেমেয়েরা এ নিয়ে মজা করে। এ বার ওরা বলেছে, বাড়িতে রান্নার বোকামি যেন না করি! বাইরে থেকে শুক্তো, চচ্চড়ি, মাছ-মাংসের নানা পদ, এমনকী আমি চাইলে পান্তা-শুঁটকি পর্যন্ত নিয়ে আসবে ওরা।’’ শুধু যে রেস্তরাঁয় এই ব্যবস্থা তা নয়। বাড়িতে খাবার সরবরাহের একাধিক অ্যাপ চালু হয়েছে এখন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পয়লা বৈশাখ আর বিজয়া দশমীর দুপুরে বাঙালি খাবারের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। অনেক ‘বিরল’ পদের ব্যবস্থাও করা হয় এই দিন। ‘‘অতিরিক্ত ডেলিভারি চার্জ নেওয়া সত্ত্বেও বিক্রিতে কোনও খামতি নেই,’’ জানালেন এমনই একটি অ্যাপের কর্তা।
সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্রের মতে, এ এক অদ্ভুত মজা! আমরা ঘরটাকে হোটেলের মতো করে সাজাতে চাইছি। আবার হোটেলে গিয়ে ঘরের খাবার, ঘরের স্বাচ্ছন্দ্য চাইছি। পয়লা বৈশাখের মতো ঘরোয়া উৎসবে এই ইচ্ছার বৈপরীত্যটা আরও বেশি করে চোখে পড়ে। তাঁর কথায়, ‘‘যে পরস্পরবিরোধী চাহিদা আমাদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে সঙ্কট তৈরি করছে, উৎসবের দিনেও তার উপস্থিতি বড় তীব্র।’’
সাহিত্যিক শংকর অবশ্য ঘর-বাইরের এই টানাপড়েনকে তেমন আমল দেননি। বস্তুত, পয়লা বৈশাখকে ঘরোয়া উৎসবের দিন বলেই মানতে চাননি তিনি। তাঁর মতে, পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য হল, আগে ওই দিনটাকে দীর্ঘ যাত্রার পক্ষে অশুভ মনে করা হত। বলা হত অগস্ত্য যাত্রা। এড়িয়েই চলা হত দিনটাকে। ওই দিনটা ছিল মূলত ব্যবসায়ীদের দিন। দোকানে নতুন খাতা চালু হত। বাঙালিরা সেই দিনে দোকানে গিয়ে পাওনা মিটিয়ে মিষ্টি খেয়ে আসতেন। এখন তো দোকানে ধার উঠে গিয়েছে। তার বদলে ক্রেডিট কার্ড এসে গিয়েছে। হালখাতা আর কোথায়?’’
প্রখ্যাত লেখিকা কল্যাণী দত্তের লেখাতেও এই ছবিই ধরা পড়ে। তিনি লিখেছিলেন, পুরনো কলকাতায় পয়লা বৈশাখ ব্যবসায়ীদের দিন হিসেবেই গণ্য হত। সন্ধ্যায় মুদি, গয়নার দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন থাকত। বাড়ির বড়দের সঙ্গে গিয়ে মিষ্টি আর রঙিন সরবত খাওয়া চলত।
অবশ্য হালখাতা যে এখন আর হয় না, তা নয়। তবে তারও চরিত্র বদলেছে। দক্ষিণ কলকাতার এক গয়নার দোকানের কর্ণধার জানালেন, আগে চিঠি পাঠিয়ে হালখাতার নিমন্ত্রণ করা হত। এখন ফোনে বা মেসেজেই হয়ে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ধার-বাকির ব্যাপার নয়। যাঁরা আমাদের নিয়মিত ক্রেতা, তাঁদের আলাদা করে ডাকা হয়। কিছু ছাড়ের বন্দোবস্ত থাকে। তাঁরা যদি কিছু কেনেন তো ভাল, না কিনলেও মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এটাকে জনসংযোগ বলতে পারেন।’’
হোয়াটস্অ্যাপে ‘হ্যাপি পয়লা বৈশাখ’ লেখার যুগে এই জনসংযোগটাই কি তবে মূল লক্ষ্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy