উদ্যাপন: ক্যানসারে আক্রান্ত অমল ঘোষের জন্মদিন পালন। নিজস্ব চিত্র
হাত কাঁপছে। কিন্তু মুখে অমলিন হাসি। কাঁপা কাঁপা হাতেই জন্মদিনের কেক কাটলেন বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টের বাসিন্দা নবতিপর অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুরা তখন প্রবল খুশি জীবনের এই উদ্যাপনে! ৯৪ বছরের অশোকবাবু আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে শুধু বলছেন, ‘‘মানুষ মানুষের কাছে এলে ভালই লাগে। একা তো আর ভাল থাকা যায় না। সকলে ভাল থাকুন।’’ তাঁর বন্ধুরাও সকলেই ষাটোর্ধ্ব। কারও বয়স পঁয়ষট্টি, কারও বাহাত্তর, কারও আরও বেশি! কিন্তু তাঁরা সকলে মিলে প্রমাণ করেছেন, বয়স একটি সংখ্যা মাত্র!
তাই বালিগঞ্জের প্রবীণেরা একজোট হয়েছেন পারস্পরিক নিঃসঙ্গতা দূর করতে। তৈরি করেছেন ক্লাব। ক্লাবে সদস্যপদ পাওয়ার একমাত্র ছাড়পত্র হল ষাট বছর, অর্থাৎ প্রবীণ নাগরিক হতে হবে। আর ওই প্রবীণ নাগরিকেরাই একজোট হয়ে পরস্পরের একাকিত্ব দূর করতে একে অপরের হাত ধরছেন।
প্রত্যেকেরই সন্তান কর্মসূত্রে দূরে থাকেন বা মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কারও স্বামী মারা গিয়েছেন, কারও আবার স্ত্রী। কিন্তু কখনও সমবেত ভাবে জন্মদিন পালন, কখনও রবীন্দ্রজয়ন্তী, কখনও আবার গলিভিত্তিক ‘কেয়ার কমিটি’ গঠন করে প্রতি সপ্তাহে একে অপরের খোঁজ রাখা— এ ভাবেই নিঃসঙ্গ প্রবীণের পাশে দাঁড়াচ্ছেন অন্য প্রবীণেরা।
ফার্ন রোডের ‘কেয়ার কমিটি’র দায়িত্বে রয়েছেন ৬৮ বছরের শ্যামল ঘোষ। শ্যামলবাবু বলেন, ‘‘বাড়িতে যাঁরা একা থাকছেন, যাঁদের ছেলেমেয়েরা দূরে থাকেন, তাঁদের খোঁজখবর করি আমরা। তাঁদের নিঃসঙ্গতা কিছুটা হলেও কাটে।’’ নিঃসঙ্গতা অবশ্যই কাটে, বলছেন অমল ঘোষ। বালিগঞ্জ প্লেস ইস্টের বাসিন্দা ক্যানসারে আক্রান্ত ৬৯ বছরের অমলবাবু স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অমলবাবু বলেন, ‘‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে সকলের খোঁজখবর করতে পারি না। কিন্তু অন্য বয়স্ক মানুষ যখন নিয়মিত আমার খোঁজখবর করতে আসেন, ভালই লাগে।’’
বয়সের গণ্ডি ডিঙিয়ে প্রবীণেরা যে প্রবীণদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেন, ‘‘আসলে এখানে কেউ অন্য কারও জন্য কিছু করছেন না। তাঁরা নিজের নিজের অবস্থান থেকেই একত্রিত হচ্ছেন।’’ যেমন কর্নফিল্ড রোডের বাসিন্দা ৭২ বছরের গায়ত্রী আচার্যের স্বামী মারা গিয়েছেন দু’বছর হল। ছেলে-বৌমা-নাতি বিদেশে থাকেন। সারাক্ষণের পরিচারিকার সঙ্গে গায়ত্রীদেবী একাই থাকেন। গায়ত্রীদেবী বলছেন, ‘‘স্বামী যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিলাম কী ভাবে দিনগুলো কাটাব। কিন্তু অন্য বয়স্ক মানুষেরা যখন আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম।’’
প্রবীণদের এই অফুরান প্রাণশক্তির কথা শুনে তাঁদের প্রবীণ বলতে নারাজ সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। নবনীতা বলেন, ‘‘তাঁরা আসলে প্রবীণ হননি। জীবনের প্রতি তাঁদের আস্থা যে অটুট, এতেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, এখনও জীবন থেকে তাঁদের অনেক প্রাপ্তি আছে। শুনে খুব ভাল লাগছে।’’ জামির লেনের ‘কেয়ার কমিটি’র দায়িত্বে থাকা কল্যাণ সেন জোরের সঙ্গে বলছেন, ‘‘আমরা কাউকে একা ছাড়ব না। ছেলেমেয়েরা দূরে থাকেন, ঠিকই। কিন্তু আমরা তো আছি!’’ অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আবার এই উদ্যোগ শুনে অভিভূত। সাবিত্রীদেবী বলছেন, ‘‘বয়স হলে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। সেখানে বয়স্ক মানুষেরাই যদি এগিয়ে আসেন, তা হলে ভাল লাগে। নিজেকে তখন একলা মনে হয় না।’’ বয়স্কদের একসঙ্গে করার দায়িত্ব যিনি নিয়েছেন, সেই স্থানীয় কাউন্সিলর সুদর্শনা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বয়স তো শুধুমাত্র একটা সংখ্যা। ওঁরা রোজ এটা প্রমাণ করছেন।’’
তবে বয়স শুধু সংখ্যাই নয়, বয়সের গণ্ডি ডিঙানো এই বন্ধুত্ব পাল্টে দিচ্ছে তথাকথিত বন্ধুত্বের সংজ্ঞাও! আক্ষরিক অর্থেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy