সাবলীল: চালকের আসনে প্রতিমা। বুধবার, নিমতায়। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
মেয়েদের অটো চালাতে দেবে না বলেছে? জানতাম, এমনই কিছু করবে! মেয়ে বলেই আমাদের যত সমস্যা। আমি যখন মিনিবাস চালানোর লাইসেন্স পেলাম, তখন আমাকেও আটকে দিয়েছিল। ২০ দিন বাস চালাতে দেয়নি। পরেও জোর করে আমাদের গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে অনেক বার। শুধু কি তা-ই? বাস চালাতে শুরু করার পরেও কত ভোগান্তি! ভাড়া না দিয়ে নেমে যাওয়া যাত্রীকে ধরতে গেলে উল্টে তারাই হাত ধরে আমাকে টেনে নামাতে চেয়েছে!
অন্যদের কাছে যেটা খুব স্বাভাবিক, আমাদের জন্য সেটাই যেন অপরাধ! গত ছ’বছর ধরে হাওড়া-নিমতা রুটে মিনিবাস চালাচ্ছি। আমি তো জানি, অন্য রকম কিছু করতে গেলে কী কী সহ্য করতে হয়। বাবুর বাড়িতে বাসন মাজলে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু সেই মেয়েরাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে বাস বা অটো নিয়ে রাস্তায় নামলে অপরাধ!
১৯৯৪ সালে শিবেশ্বর পোদ্দারের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। শিবেশ্বর তখন অটো চালায়। পরে ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে। আমাদের দুই মেয়ে। আমি যে খুব ভেবেচিন্তে বাস চালাতে শুরু করেছি, তা নয়। মেয়েদের পড়াশোনা, সংসারের খরচ—সবটা শিবেশ্বরের একার পক্ষে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। অন্য মহিলারা ঠিক যে কারণে কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, আমিও সেই কারণেই গাড়ি চালানো শিখতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, ওই মেয়েরাও একই কারণে অটো চালাতে চাইছেন।
মনে পড়ে, কাজ থেকে ফিরে শিবেশ্বর আমাকে ট্যাক্সি চালানো শেখাতে নিয়ে যেত। ২০১২ সালে আমি চার চাকার লাইসেন্স পাই। তবে এ ভাবে অন্য রকম কিছু করতে গিয়ে অপদস্থ হতে হয়েছে বারবার। প্রথমেই বেঁকে বসলেন নিমতা স্ট্যান্ডের বাসচালকেরা। ওখানকার সংগঠন খুব ঝামেলা শুরু করল। ২০ দিন ডিপোয় পড়ে থাকল আমাদের বাস। পরেও আমাদের গাড়ি আটকে রাখা হয়েছে বহু বার। তবে আমি হার মানিনি। এমনও দেখেছি, মহিলা চালক বলে অনেকেই আমাদের গাড়িতে উঠতে চাইছেন না। পরে ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছে তাঁরাই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন।
এক দিন এক বয়স্ক মহিলাকে গাড়িতে তুলছিলাম। দেরি করিনি, তবু এক ট্র্যাফিক পুলিশ রেগে গিয়ে গাড়ির লুকিং গ্লাস ভেঙে দিলেন। ওই পুলিশ নিজেই তো আইন ভাঙলেন। লুকিং গ্লাস তো বাসের চোখ। বাকি রাস্তাটা কী ভাবে যাব, তা কি ভেবেছিলেন তিনি? যাত্রী নিরাপত্তাই আমার কাছে সবার আগে। বরং বলব, মহিলাদের চালাতে দিলে রাজ্যে দুর্ঘটনা অনেক কমবে। কারণ, আমরা নেশা করে বাস চালাই না। আর অনেক বেশি নিয়ম মেনে চলি।
স্বামীর সাহায্য না পেলে এ কাজ হত না। তবে আমার শ্বশুরবাড়ির অনেকেই আমার বাস চালানো মেনে নেননি। কেউ বুঝতেই চান না যে, পুরুষদের অপমান করতে আমি মিনিবাস চালাই না। ওই মেয়েরাও পুরুষদের অপমান করতে অটো চালাতে চাইছেন না। আমরা বাস-অটো চালানোর কথা ভাবি, কারণ এটা আর পাঁচটা পেশার মতোই আর একটা পেশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy