ছবি সৌজন্যে শাটারস্টক।
বাঙালির নিয়মমাফিক জীবনে একটা দিন থাকবেই অনিয়মের জন্য। কেনাকাটা, সিনেমা দেখার পরেই রেস্তরাঁয় চিকেন বা মাটনের আইটেম চেখে নেওয়া যেন বাঙালির রোজ রুটিনের বাইরেও আর এক রুটিন। কিন্তু, সে পাতেও হানা দিয়েছে ভাগাড়ের অমাংস-কুমাংস। আজ নয়, দীর্ঘ সাত বছর ধরে বাঙালির পেটে ঢুকছে পচা মাংস, শরীরে মিশছে বিষ। প্লাস্টিক ডিম, ফরম্যালিনে চোবানো মরা মুরগি, রং মেশানো সব্জি, আর এখন ডাম্পিং ইয়ার্ডের পচা মাংস— এ সবই বাঙালির জানা। এত কিছুর পরেও কি টনক নড়েছে বাঙালির? না কি জেনে শুনেই বিষপান?
ছেলের ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য কোচবিহার থেকে কলকাতায় এসেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুব্রত দে। উঠেছেন শিয়ালদহে বৈঠকখানা রোডের একটি হোটেলে। ফুটপাতের দোকান থেকেই স্ত্রী আর পুত্রের হাতে তুলে দিয়েছেন এগরোল। এ দিকে ছেলে নাছোড়বান্দা চিকেন রোল খাবে। কিন্তু সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘বড্ড ভয় হচ্ছে জানেন। সব রকম মাংসই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। ডিমটা দিয়েই চালাচ্ছি। সেখানেও আবার চাপ। খাবটা কি? সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছি, খাবার-দাবারের উপর কোনও নজরদারি থাকবে না? কী করছে ফুড কন্ট্রোল বোর্ড?’’
বেলেঘাটার রাস্তায় খোশমেজাজে মাটন রোল খাচ্ছিলেন দুই বন্ধু চিরঞ্জিত ঘোষ আর অভিজিৎ মণ্ডল। ভাগাড়ের মাংস পেটে ঢুকল কি না, তাতে কিস্সু যায় আসে না ওঁদের। চিরঞ্জিতের বক্তব্য, ‘‘সবই তো ভেজাল। আগে না জেনে খেয়েছি, আর এখন জেনে খাচ্ছি। সুতরাং যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন আর বাতিক করে কী লাভ?’’ অভিজিৎ একটু যোগ করে বললেন, ‘‘খিদে পেয়েছে, পকেটে বেশি টাকাও নেই যে রেস্তরাঁয় বসে খাব। আসা যাওয়ার পথের দোকানই যুগ যুগ জিও।’’
ছুটির দিনে চুটিয়ে প্রেমপর্বের মধ্যেই পড়ে আমিনিয়ায় ঋতব্রত আর সুলগ্নার ভূরিভোজ। মাংসের পোকা ঋতব্রত বলছেন, ‘‘সিনেমায় তো কাউয়া বিরিয়ানি বলে খাইয়েছিল, আর এখানে না বলে। রেড মিটে বরাবরই আমার আপত্তি। কেন না এক বার রান্না হয়ে গেলে কোয়ালিটি বোঝা দুষ্কর। একমাত্র এই আমিনিয়ার রেডমিট নিশ্চিন্তে খেতে পারি। আর ভাগাড়-কাণ্ডের পর রেডমিট টোটালি স্টপ। তবে এই চক্র সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। মৌচাকে ঢিল যখন পড়েছে, মৌমাছিরা ধরা দেবেই।’’ তবে প্রশাসন যে এই বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী সুলগ্না। বললেন, ‘‘ডেঙ্গু হোক বা মরা মুরগি সবেতেই কেএমসি ব্যবস্থা নিয়েছে, এ বারও নেবে।’’
কী বলছেন মানুষ দেখে নিন
আর এই প্রশাসনের প্রতিই তীব্র ক্ষুণ্ণ রাসবিহারীর লোপামুদ্রা পোড়েল। ‘‘কলকাতা পুরসভা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে নারকেলডাঙার ওই কোল্ডস্টোরেজ। এত দিনের কারবার, পুরসভা ঘূণাক্ষরেও টের পেল না,’’— মেয়ের জন্য এগরোল কিনতে কিনতেই পুরসভার উপর ক্ষোভ উগরে দিলেন লোপামুদ্রা।
মেয়ের বায়নাক্কাতেই হাওড়া মন্দিরতলা থেকে দেশপ্রিয় পার্কের ট্যামারিন্ড রেস্তরাঁয় সপরিবারে ডিনার করতে চলে এসেছেন রোমি রায় শী। বললেন, ‘‘আমি স্ট্রিট ফুড ছুঁয়ে অবধি দেখি না। এই ট্যামারিন্ডে বসেই নিশ্চিন্তে খাওয়া-দাওয়া করতে পারি।’’ স্বামীর দিকে তাকিয়ে আর একটু যোগ করলেন, ‘‘ও বলছিল, শোনো এই সময়টাতেই গেলে ফ্রেশ খাবার পাবে। এখন সব রেস্তরাঁ মালিকের মধ্যেই ভয় আছে।’’ আরও বললেন, ‘‘সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। একটা ব্যাকআপ না থাকলে ৭ বছর ধরে এমন কারবার চলতে পারে না। আর এই নোংরা কারবারীদের মাথায় উঁচু মহলের হাত আছেই।’’
তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বড় ভয় হয় রোমির। বলছেন, ‘‘আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা একটু বেশিই। আমার মেয়েও ঝোঁক ধরে ফাস্টফুড খাবে বলে। আজ না হয় ও আমাকে লুকিয়ে খেতে পারছে না, কিন্তু এক দিন তো বড় হবে, তখন?’’
এমনই চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন আরও অনেক মায়েরা। স্লিপিং পিলটা একমাত্র প্রশাসনেরই হাতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy