বিভঙ্গ: নজরুল মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে ‘সোয়ান লেক’। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
অনেক অনেক দিন আগে, এক হ্রদের ধারে অভিশপ্ত রাজকন্যা ওডেটের সঙ্গে দেখা হয় রাজপুত্র সিগফ্রিডের। প্রথম দেখা থেকে মুগ্ধতা, প্রেম। কুচক্রী জাদুকর রথবার্ট ও তার মেয়ে ওডিলের বোনা ষড়যন্ত্রের জাল কেটে বেরিয়ে আসার চেষ্টা যুগলের। শেষমেশ চিরকাল ভালবেসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিতে শাপমুক্তি।
বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় নজরুল মঞ্চে কলকাতা সাক্ষী থাকল এমনই এক কাহিনির। সৌজন্যে ইউক্রেনের দল, রাশিয়ান রয়্যাল ব্যালে। শ’দেড়েক বছর আগে সুরকার পিওতর ইলিচ চাইকোভস্কি রুশ উপকথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেছিলেন ‘সোয়ান লেক’। প্রথমটায় তেমন কল্কে না পেলেও এখন ধ্রুপদী ব্যালের তালিকায় সোয়ান লেক অবশ্যই থাকে প্রথম কয়েকটা নামের মধ্যে।
গত বছর গুরুগ্রামের এক প্রযোজক সংস্থার হাত ধরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সোয়ান লেক। ওই সংস্থার পক্ষে দীনেশ সিংহ জানান, অভাবনীয় সাড়া মেলায় এ বার দীর্ঘ হয়েছে তালিকা। তিন শহর ঘুরে এ বার পালা কলকাতার। আজ, শুক্রবার ও শনিবার ফের দেখা যাবে এই ব্যালে।
এ দিনের অনুষ্ঠানের আগে এই দলের প্রতিষ্ঠাতা, পরিচালক আনাতোলি কাজাতস্কি বলছিলেন সোয়ান লেকের বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তার কথাই। তাঁর মতে, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, ভালবাসার জোরে বাধাকে জয় করার বিশ্বজনীন ও চিরকালীন গল্পই রয়েছে এই সাফল্যের মূলে। তাই নতুন কোনও দেশে সোয়ান লেক উপস্থাপিত করতেই পছন্দ করেন পরিচালকেরা। ব্যতিক্রম নন আনাতোলিও। ‘‘নাচ, ইউরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত আর নাটকীয়তার মিশেলে ব্যালে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সরল গল্প আর আবেগমথিত সুরের জোরে প্রথম বার ব্যালে দেখতে আসা দর্শকও বুঝতে পারেন সবটা।’’—বলেন আনাতোলি। দেড়শো বছরে ব্যালে নাচের আঙ্গিকে অনেক বদল এসেছে, বদলেছে নৃত্য পরিকল্পনাও। জানা গেল, গল্পের শেষটুকু মিলনান্তক হোক, এমনই চাইছেন আধুনিক ব্যালে-প্রেমীরা।
এ দিন বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলেন মণিকা রায়। বিরতির সময়ে টুকটাক গল্পের ফাঁকে বললেন, ‘‘কলকাতায় বসে ব্যালে দেখার সুযোগটা হারাতে চাইনি। নীল আলোর মায়াবি জগতে যেন মেঘের মতো ভেসে বেড়ালেন শিল্পীরা। যেমনটা কল্পনা করেছিলাম, তার থেকেও ভাল লাগল।’’ মৃদুলা চৌধুরীর আবার লন্ডনে ব্যালে দেখার সুযোগ হয়েছিল। এখানে তুলনায় ছোট মঞ্চেও শিল্পীরা বেশ মানিয়ে নেওয়ায় তাঁদের প্রশংসা করছিলেন তিনি। নৃত্য নির্দেশক ভ্লাদিমির ত্রসচেঙ্কোর অবশ্য বক্তব্য, যেখানে ব্যালের প্রচলন নেই, সেখানে সব সুবিধা মিলবে না, সেটাই স্বাভাবিক। বরং জায়গা অনুযায়ী নৃত্য-পরিকল্পনা ও মঞ্চসজ্জা করতে পারাটাই তাঁদের উদ্দীপনা জোগায়।
প্রধান ব্যালেরিনা এলিজাভিয়েতা লোবাচেভা ছিলেন ওডেট-ওডিল দুই ভূমিকাতেই। ওডেটের ভূমিকায় তাঁর চলাফেরা মেদুর, স্বপ্নালু। আবার তীক্ষ্ণ, দ্রুত ভঙ্গিতে ওডিলের আগ্রাসী মনোভাবের চমৎকার উপস্থাপনায় দর্শকদের মন জয় করতেও সমান সফল এলিজাভিয়েতা।
এ দিন শিল্পীরা যেমন সুললিত, অনায়াস ছন্দে মুগ্ধ করে রাখলেন দর্শকদের, তা তাঁদের দীর্ঘ, একাগ্র অনুশীলনেরই ফসল। ত্রসচেঙ্কো জানালেন, ছোট থেকে শারীরিক সক্ষমতা আর মনের জোর— দু’য়েরই ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয় ব্যালে-শিল্পীদের। ফুয়েতে, অর্থাৎ এক পায়ের আঙুলের উপরে ভর দিয়ে টানা ঘুরতে থাকা ব্যালের অন্যতম কঠিন ছন্দ বলে মনে করা হয়। আর ওডিলের একটি দৃশ্যেই ফুয়েতে রয়েছে ৩২টি। এ জন্য প্রধান ব্যালেরিনারা দিনে আট ঘণ্টা পর্যন্তও অনুশীলন করে থাকেন।
উদ্যাপনের উচ্ছ্বাস হোক বা আশা-নিরাশার ধূসর দোলাচল— চাইকোভস্কির সুরের জাদুতে এ দিন সন্ধ্যায় দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল সব অনুভূতিই। দেশ-কাল-অপরিচিতির গণ্ডি ছাপিয়ে প্রেক্ষাগৃহে তখন শুধুই স্বতঃস্ফূর্ত করতালি। যার রেশ রয়ে গেল অনুষ্ঠানের শেষেও, যখন সমবেত ভাবে দাঁড়িয়ে দর্শকেরা অভিনন্দন জানালেন শিল্পীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy