Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Footpath Library Kolkata

পথের বই আলো দেখাচ্ছে কলকাতার যিশুদের

শৈশবের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ তো অনেক দূর, অ-আ-ক-খ শেখার বইও যাদের ছিল না, তাদের নাগালের ভেতরেই এসে গেল নানা রঙের বই। সৌজন্যে বইঘর। কলকাতার তিলজলায় গড়ে উঠেছে এমনই এক স্বপ্নের লাইব্রেরি।

পছন্দের বই পড়ছে খুদেরা।— নিজস্ব চিত্র।

পছন্দের বই পড়ছে খুদেরা।— নিজস্ব চিত্র।

সোমনাথ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৮ ১৬:৫৪
Share: Save:

তিলজলার ওই এঁদো গলিটা চলে গিয়েছে খালপাড় ধরে। চার পাশে গজিয়ে ওঠা যত্রতত্র ঝুপড়ি। একটা যেন আর একটার ঘাড়ে উঠে পড়ছে!

ছোট্ট এক একটা ঘুপচি ঘর। সেখানেই পাঁচ-ছ’জনের সংসার। পা লম্বা করে শুতে গেলে ভাতের হাঁড়িতে তা ঠেকে যায়! সব অর্থেই একেবারে টানাটানির জীবন।

কেউ ভ্যানরিকশা চালান। কেউ বা জুতোর কারখানায় কাজ করেন। কেউ আবার বিভিন্ন জায়গায় ফেরি করে আচার বিক্রি করেন। দিন গেলে কোনও রকমে এক-দেড়শো টাকা হাতে আসে। সামান্য সেই টাকায় এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে চাল-নুন-তেল-ঝাল জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়। সন্তানদের স্কুলে পাঠানো স্বপ্নের অতীত। কোথা থেকে আসবে সে সবের খরচ! ভেবেই নাগাল পায় না ওই পরিবারগুলি। তাই, সে সবের পাট চুকেছে।

রিকশা থামিয়ে পথের লাইব্রেরির বই ঘাঁটছেন চালক। -নিজস্ব চিত্র।

কিন্তু, কয়েক মাস আগে হঠাৎ এক দিন সকালে দেখা গেল চমক! খালপাড়ের ফুটপাতের দেওয়ালে কাঠের সেল্ফে থরে থরে সাজানো হচ্ছে বই। সহজপাঠ, ঠাকুরমার ঝুলি, গোপালভাঁড়... কী নেই সেই ভান্ডারে! হিন্দি, এমনকি ইংরেজি বইও ঠাঁই পেয়েছে সেখানে। কাদের জন্য? প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকে গোটা মহল্লায়। একে একে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে— তাদের জন্য ‘বইঘর’ তৈরি হয়েছে ফুটপাথে।

দেখুন বইঘরের ভিডিয়ো:

বোঝা গেল, ওই সব পরিবারের কচিকাঁচাদেরও পড়াশোনার ইচ্ছে রয়েছে। শৈশবের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ তো অনেক দূর, অ-আ-ক-খ শেখার বইও যাদের ছিল না, তাদের নাগালের ভেতরেই এসে গেল নানা রঙের বই। এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ছিল বটে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার বদলে কোনও একটা কাজে জুতে যাওয়াই ওই পরিবারগুলোর সন্তানদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিয়ে মাঝপথেই ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু, বইয়ের ওই সেল্ফগুলো তাদের জন্যই তৈরি হয়েছে জানতে পেরে আনন্দের একটা হাওয়া বয়ে গিয়েছিল খালপাড় জুড়ে।

সে দিনের পর থেকে বইয়ের আর অভাব হয় না ওদের। স্কুলে না গেলেও ওরা পড়ে। এমনকি, বাড়িতেও বই নিয়ে যায়। বই ফেরত না দিলেও কেউ কাউকে বকে না। রাত হোক বা দিন, যখন ইচ্ছে বই নিয়ে বাড়ি চলে যায় নেহা পরভিন, ভোলা সাউ, রেশমি খাতুনরা। কোনও টাকা লাগে না। পড়া হয়ে গেলে, আবার যথাস্থানে বই রেখে যায় ওরা। সেটাই এখন অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।

এ-ও এক কলকাতা।

তিলজলার ফুটপাথে লাইব্রেরি। -নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: নিরাপত্তা নয়, ভিন‌্ ধর্মী যুগলকে পরিচয় লুকিয়ে রাজ্য ছাড়ার নিদান পুলিশের!

তিলজলার খালপাড়ের ফুটপাতের দেওয়ালের নতুন ওই ‘বইঘর’ ফের ওদের পড়তে শিখিয়েছে। আবার ওরা ভর্তি হচ্ছে স্কুলে। দাদা-দিদিদের দেখে বস্তির খুদেরাও রাস্তার ‘বইঘর’ থেকে বই এনে পড়ছে। শুধু তিলজলাই নয়, এমন ‘বইঘর’ একে একে গড়ে উঠছে তপসিয়া, পার্ক সার্কাস, ভবানীপুর, নিউটাউন, সল্টলেক, সেলিমপুরে।

সরকার পোষিত লাইব্রেরিগুলো যেখানে ধুঁকছে, কেউই যায় না, সেখানে রাস্তার এই বইঘর কিন্তু ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে শহরে। ‘আই লিড’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা কলকাতা পুরসভার সহযোগিতায় শহরের ৯টি জায়গায় এমন লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে। ওই সংস্থার কর্ণধার প্রদীপ চোপড়ার ইচ্ছে, শহরের পার্কে, বাস স্ট্যান্ডে, পিছিয়ে পড়া এলাকায় এমন আরও ‘বই ঘর’ করবেন।

আরও পড়ুন: অনার্সে ভর্তির টোপে টাকা আদায়, ধৃত ছাত্র

হঠাৎ এমন ভাবনা মাথায় এল কেন? প্রদীপের কথায়, “সে বার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে এমনটা দেখেছিলাম। রাস্তার পাশেই সেল্ফে সাজানো থরে থরে বই। যার যেমন ইচ্ছে, পড়ছে, নিয়ে যাচ্ছে। তখনই ভেবেছিলাম, আমাদের শহরেও তো এমন ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা যাতে বিনা পয়সায় বই পড়তে পারে।” সেটাই করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন প্রদীপ। পেশায় ব্যবসায়ী প্রদীপকে অনেকেই প্রথমে প্রশ্ন করেছিলেন, খোলা আকাশের নীচে অরক্ষিত অবস্থায় বই থাকবে তো? রাতের অন্ধকারে বই চুরি হয়ে যাবে তো? কিন্তু, তেমনটা হয়নি। ‘‘ছ’মাস হয়ে গেল, কোথাও একটা বইও চুরি হয়নি,’’—তৃপ্তির হাসি হেসে জানালেন প্রদীপ।

তিলজলার ওই খালপাড়ের ঝুপড়িতে থাকে নেহা পরভিন। তার বাবা গাড়িতে করে আচার বিক্রি করেন। আগে বাড়ির কাজেই দিন কেটে যেত নেহার। সেই মেয়েই এখন সকাল-বিকেল নিয়ম করে পড়াশোনা করে। বইঘর থেকে নানা ধরনের বই এনে পড়ে। কেমন লাগছে এত বই হাতের কাছে পেয়ে? একগাল হেসে নেহা বলল, “একসঙ্গে এত বই কখনও দেখিনি। তা-ও আবার বিনা পয়সায়! পড়াশোনার ইচ্ছেটাই বেড়ে গিয়েছে।” মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল নেহা। এখন আবার সে স্কুলে যাচ্ছে। উৎসাহ দিচ্ছে প্রদীপের সংস্থা আই লিড।

আরও পড়ুন: ডাক্তারদের পাশে আছি, বার্তা পুলিশের

আরও পড়ুন: আম আদমির ফেসবুক পোস্ট ‘চুরি’! অভিযুক্ত কলকাতা পুলি‌শ

কিন্তু, রাস্তার ওই বইঘরের বই কোথা থেকে আসে? প্রদীপের কথায়, “প্রথমে নিজেই বই জোগাড় করতাম। এখন অনেকেই জেনে গিয়েছেন। স্ট্রিট লাইব্রেরিগুলোতে রাখা ফোন নম্বর দেখে বহু মানুষ ফোন করছেন বই দেওয়ার জন্য। ইতিমধ্যেই প্রচুর বই জমাও পড়েছে আমাদের দফতরে। আরও বই আসছে। মানুষ এমন ভাবে সাড়া দেবেন, ভাবতে পারিনি। অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতা!”

নেহা যেমন ফের ক্লাস নাইনে গিয়ে আবার ভর্তি হয়েছে, তার দেখাদেখি পাশের ঝুপড়ির ভোলাও ফের শুরু করেছে পড়াশোনা। এখন তার ক্লাস সেভেন। বাবা রান্নার কাজ করেন। বাবার পক্ষে যে বই কিনে দেওয়া যে সম্ভব নয়, বয়সে ছোট হলেও ভোলা তা ভাল করেই বোঝে। তার কথায়, “কত্ত বই জানো। আমার বই পড়তে খুব ভাল লাগে। কিন্তু, এত দিন আমার কোনও বই ছিল না। এখন তো যখন ইচ্ছে, তখনই বই পড়তে পারি।’’

ফুটপাথের লাইব্রেরিতে এক বইপড়ুয়া। ভবানীপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শুধু পিছিয়ে পড়া শিশুরাই নয়, বইঘরের প্রেমে পড়েছেন পথচলতি মানুষরাও। ভবানীপুরে যেমন দেখা গেল, বইঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বই নাড়াচাড়া করছেন এক রিকশাচালক। বই পড়ছেন? জবাব এল, “একটু দেখছি। এখান থেকে তো বই বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া যায় শুনছি। ভাবছি, ছেলেমেয়ের জন্য বাড়িতে বই নিয়ে যাব। ওরাও পড়বে।”

আরও পড়ুন: শতাব্দীর দীর্ঘতম পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ জুলাইয়ে, দেখা যাবে কলকাতাতেও​

এ সব দেখে ভীষণ খুশি প্রদীপ। তিনি বললেন, “আমি তো ব্যবসায়ী মানুষ। লাভ-ক্ষতির হিসেব কষি সারা ক্ষণ। কিন্তু, এই কাজে একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।” মাঝে মাঝেই বইঘরগুলোয় যান। ওই সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কী ধরনের বই পড়তে ইচ্ছে করে, তা নিয়েও কথা বলেন। সেই মতো বই পাঠিয়েও দেন বইঘরগুলোতে। তিনি বলেন, “কলকাতার মানুষ আসলে বই পাগল। বইমেলা দেখলেই তা বোঝা যায়। কিন্তু, অনেকেরই সেখান থেকে বই কিনে পড়ার সামর্থ নেই। তাই বইঘরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।’’ পাশাপাশি তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের সহযোগিতা পেলে এ রকম আরও লাইব্রেরি গড়ে তোলা যাবে।

আরও পড়ুন: পণের চাপ, স্বামীর অন্য সম্পর্ক, মানিকতলায় উদ্ধার বধূর দেহ​

রাজ্য সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের তত্ত্বাবধানে একটি বেসরকারি সংস্থা এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করে। সেই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কলকাতার রাস্তায় ১৬ হাজার পথশিশু পেটের তাগিতে ঘুরে বেড়ায়। কখনও তারা ছোটখাটো দোকানে কাজ করে। কখনও বা হোটেলে। এমনকি, পথে পথে ভিক্ষা করতেও দেখা যায় তাদের। তাই প্রশ্ন ওঠে, নেহা বা ভোলার মতো কত পথশিশু এমন সুযোগ পাচ্ছে?

প্রদীপের মতে, ওই শিশুদের খুব সামান্য অংশই এখন এই বইঘরের সুবিধা পাচ্ছে। আরও পথশিশু যাতে বই পড়ার সুযোগ পায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট তাঁর সংস্থা। রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অন্যন্যা চক্রবর্তীও এমন কাজের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, “শিশু ও নারীর সুরক্ষায় রাজ্য সরকার সব সময় সচেষ্ট। শিশুরা যাতে স্কুলমুখী হয়, সব সময় আমরা নজর রাখি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিই। বইঘরের উদ্যোগ খুবই ভাল।”

আরও পড়ুন: সংবিধানে ৬০ বছরের পুরনো ‘টাইপো’ ঠিক করার আবেদন ফ্রান্সে

তবে শুধু রাস্তার ধারেই নয়, এমন বইঘর প্রদীপ গড়ে তুলতে চাইছেন শহরের অনেক জায়গাতেই। পার্ক থেকে শুরু করে বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন— সর্বত্র। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই পার্কে যান। বাসস্ট্যান্ড বা রেল স্টেশনে যাত্রীদের অনেক সময়েই অপেক্ষা করতে হয়। ওই সব জায়গাতে যদি এমন লাইব্রেরি গড়ে তোলা যায়, তা হলেও ইন্টারনেটের এই যুগে মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহটা জাগিয়ে তোলা যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Library Footpath Kolkata Tiljala
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE