উড়ালপুলে বন্ধ পার্ক সার্কাসমুখী লেন। — নিজস্ব চিত্র
পাঁচশো কোটির বিনিময়ে একটা অসম্পূর্ণ উড়ালপুল। নকশার সঙ্গে ভারসাম্যবিহীন নির্মাণ। তাই উদ্বোধনের দু’মাস পরেও পরমা উড়ালপুল থেকে প্রাপ্তি নাম মাত্র। গত ৯ অক্টোবর পরমা উড়ালপুল উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নাম রেখেছেন ‘মা’। কিন্তু যানজট কমিয়ে যাতায়াত মসৃণ করার বদলে তা যান-যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠল। কেউ কেউ বলছেন, জননী-যন্ত্রণা!
ভোট বড় বালাই
উদ্বোধনের কিছুক্ষণ পর থেকেই মাথায় হাত ট্রাফিক পুলিশের। পরমা উড়ালপুল থেকে পার্ক সার্কাসমুখী লেন এবং পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড় পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রথম দিনেই ওই উড়ালপুলের যানজট সামলাতে কালঘাম ছুটে যায় ট্রাফিক পুলিশের। পরদিন বেশ কয়েক জন ট্রাফিক সার্জেন্টকে পার্ক সার্কাস ‘সেভেন পয়েন্ট’-এ নামানো হয় ট্রাফিক সামলাতে। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। এর পরে বন্ধই করে দিতে হয় উড়ালপুলকে। কিন্তু ভোটের আগে তড়িঘড়ি উদ্বোধন করে উড়ালপুল ফের বন্ধ করে দিলে মুখ পুড়বে সরকারের। তাই শেষমেশ, ‘মা সেতু’র পথ একমুখী করার সিদ্ধান্ত নেয় লালবাজার।
এই সিদ্ধান্তের পরে দু’মাস কেটে গিয়েছে। এখনও পার্ক সার্কাস থেকে বাইপাসমুখী লেনেই গাড়ি চলে দিনভর। রাত ন’টার পরেই একমাত্র দু’মুখী হয় উড়ালপুল। কেএমডিএ-র সিইও সুরেন্দ্র গুপ্ত আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিছু দিনের মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আশ্বাসই সার, পরিস্থিতি বদলায়নি।
গলদ যেখানে
কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)-র তদারকিতে তৈরি হয়েছে এই উড়ালপুল। কিন্তু শহরের তাবড় ইঞ্জিনিয়ার এবং নগর পরিকল্পকেরা বলছেন, পরমা উড়ালপুলের ভাবনাতেই গলদ রয়েছে। তাঁদের কথায়, যে কোনও উড়ালপুল তৈরির আগে ওই ক্রসিংয়ে কত গাড়ি চলাচল করে, তার সমীক্ষা করা প্রয়োজন। হিসেব কষা প্রয়োজন, ১০ বছর পরে
ওই ক্রসিংয়ে গাড়ির চাপ কত
বাড়তে পারে।
তা ছাড়া, ওই ক্রসিংয়ে কোন ধরনের গাড়ির চাপ বেশি, তা-ও জানা প্রয়োজন সমীক্ষায়। অথচ সে সব সমীক্ষা না করেই ২০০৫ সালে প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়ে যায়। তখন মূল নজর ছিল পার্ক সার্কাসের সাত রাস্তার মোড়ে। বিমানবন্দর বা গড়িয়ার দিক থেকে আসা গাড়িগুলি পরমা উড়ালপুল ধরে এসে পড়বে পার্ক সার্কাস সাত রাস্তার মোড়ে। সাত রাস্তার মাথায় থাকবে একটি চাকার আকৃতির ক্রসিং। পার্ক সার্কাস ক্রসিং থেকে চারটি রাস্তা নেমে মিশবে পার্ক স্ট্রিট, সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ, সুরাবর্দি অ্যাভিনিউ, এজেসি বসু রোড উড়ালপুলের দিকে। এতে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হতো ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে কেএমডিএ। প্রধান কারণ অবশ্যই খরচ। কেএমডিএ-র ইঞ্জিনিয়ারদের একাংশের এ-ও বক্তব্য ছিল, চক্রাকার ক্রসিংয়ের যানজট থেকে মুক্তি পাওয়া কার্যত অসম্ভব হবে। তার থেকে পরমা উড়ালপুলের মুখ পার্ক সার্কাস ক্রসিংয়ে মিশিয়ে দেওয়াই ভাল।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, পরমা উড়ালপুল পার্ক সার্কাস ক্রসিংয়ে নামার আগে একটি দিক চলে যাবে এজেসি বসু রোড উড়ালপুলে। আর একটি দিক পার্ক সার্কাস ক্রসিংয়ে গিয়ে পড়বে। উল্টো দিকেও ঠিক একই ভাবে এজেসি বসু রোড উড়ালপুল থেকে একটি অংশ গিয়ে মিশবে পরমা উড়ালপুলে। অন্যটি নামবে পার্ক সার্কাস ক্রসিংয়ে। এর পরে গত ছ’বছর ধরে জমি অধিগ্রহণ-সহ নানা জট কাটাতে কাটাতে, ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পের খরচ ৫০০ কোটিরও বেশি হয়ে গিয়েছে।
কাঠগড়ায় বাঙালি
গোড়ায় গলদটা হল, বাঙালির কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সেতুবন্ধন নেই। তাই, সেতু হোক বা রাস্তা— বাঙালির সাহস ও পরিকল্পনার অভাবে নির্মাণের উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। বাস্তবে সেতু একটা হয় বটে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না।
বাম আমলের প্রথম দিকে তৈরি হওয়া শিয়ালদহ উড়ালপুল কিংবা হালফিলের পরমা উড়ালপুল প্রমাণ করেছে বাঙালির সঙ্গে সেতু বা সড়ক স্থাপত্যের সম্পর্কটা তেল আর জলের। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল হয় না কখনও। উড়ালপুলগুলি যে শেষ পর্যন্ত সমস্যা মেটাতে পারছে না, তার জন্য অবাস্তব পরিকল্পনাকেই দায়ী করেছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। এক স্থপতির তির্যক মন্তব্য, ‘‘এই সব পরিকল্পনা দেখলে মনে হয়, কালিদাস
বাঙালি ছিলেন।’’
অতঃ কিম্
পরিস্থিতি এমনই যে, উড়ালপুল নিয়ে আপাতত মুখে কুলুপ সংশ্লিষ্ট কর্তাদের। তবে একটি সূত্রের দাবি, পার্ক সার্কাসের মুখে পরমা উড়ালপুল থেকে দু’টি পৃথক এলিভেটেড রাস্তা বার করা হচ্ছে। একটি কংগ্রেস এগজিবিশন রোডের উপর দিয়ে গিয়ে পড়বে এজেসি বসু রোড উড়ালপুলে। অন্যটি এজেসি বসু রোড থেকে পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ের উপর দিয়ে আসবে পরমা উড়ালপুলে। ওই দু’টি রাস্তা তৈরি হলেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে বলে দাবি
ওই কর্তাদের।
যদিও ওই উড়ালপুলের সবিস্তার প্রকল্প রিপোর্ট প্রস্তুতকারী সংস্থা আগেই জানিয়েছিল, এজেসি বসু রোড উড়ালপুলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি না করে ‘মা সেতু’র উদ্বোধন করলে পার্ক সার্কাসের ট্রাফিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। এ বার ওই দুই রাস্তা তৈরি হলে যানজট কিছুটা কমলেও সমস্যা পুরোপুরি মিটবে বলে মনে করছেন না ওই সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারেরা। সংস্থার এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘৫০০ কোটির উড়ালপুলকে তো আর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই ‘কানা মামা’-কে নিয়েই থাকতে হবে!’’
উদ্যোগী হাইকোর্ট
পরমা উড়ালপুলের সমস্যা নিয়ে উদ্যোগী কলকাতা হাইকোর্টও। সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে মঙ্গলবার দুপুরে হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত তাঁর চেম্বারে কলকাতা ট্রাফিক পুলিশ, কেএমডিএ এবং উড়ালপুল তৈরির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন।
সূত্রের খবর, কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুপ্রতিম সরকার বিচারপতি দত্তকে জানান, এজেসি বসু রোড উড়ালপুল থেকে পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে পূর্বমুখী রাস্তার কাজ আগে শেষ হওয়া প্রয়োজন। তার পরে কংগ্রেস এগজিবিশন রোড, নাসিরুদ্দিন রোড, সার্কাস অ্যাভিনিউ হয়ে পশ্চিমমুখী রাস্তার কাজ শুরু করতে হবে। আগে পশ্চিমমুখী রাস্তাটি তৈরি করতে গেলে বিস্তর যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া, সামনে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। বইমেলাও শুরু হবে। রয়েছে বিয়ের মরসুমও।
ঠিকাদার সংস্থার পক্ষ থেকে বিচারপতি দত্তকে জানানো হয়, পূবর্মুখী রাস্তার কাজ শেষ হতে আগামী বছরের মে মাস হয়ে যাবে। ২০১৭ সালে শেষ হতে পারে পশ্চিমমুখী রাস্তা তৈরির কাজ। বিচারপতি দত্ত এ দিন উপস্থিত সব পক্ষকে জানিয়েছেন, কাজের অগ্রগতি নিয়ে আগামী জানুয়ারি মাসে ফের বৈঠক ডাকবেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy