চোখ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এমনিতেই তামিলনাড়ু, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের থেকে অনেক পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। তার উপরে নির্লিপ্ত স্বাস্থ্যকর্তাদের চোখের সামনেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে ‘হসপিটাল কর্নিয়া রিট্রিভ্যাল প্রোগ্রাম’ মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। এর মধ্যে এসএসকেএম, ন্যাশনাল মেডিক্যাল, এনআরএস-এর মতো প্রথম সারির মেডিক্যাল কলেজ, এমআর বাঙুরের মতো নামী হাসপাতাল রয়েছে। নীলরতনে ‘অতুল বল্লভ’-এর মতো চক্ষু ব্যাঙ্ক থাকা সত্ত্বেও তার সংগ্রহ তলানিতে। বিগত দু’বছরের কোনওটিতেই এই চার হাসপাতালে সংগৃহীত মোট চোখের সংখ্যা হাজার পার করতে পারেনি।
তবুও রাজ্যের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (চক্ষু) সিদ্ধার্থ নিয়োগীর নিরুত্তাপ জবাব, ‘‘হাসপাতালগুলিতে চোখ সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা বেসরকারি হাসপাতালের কাউন্সেলরেরা কাজে ফাঁকি দিলে কী করব? ন্যাশনালের মতো বহু জায়গায় সরকারি চক্ষু চিকিৎসকেরাই চোখ তুলতে বাধা দিচ্ছেন! জানিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করবেন না।’’ কিন্তু যে বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে না, তাকে বাতিল করে অন্য সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন? সিদ্ধার্থবাবুর উত্তর, ‘‘আপনারা সব বুঝবেন না। এদের সরালে অন্য কোনও সংস্থা পাওয়া যাবে না!’’ আর যে সব সরকারি চক্ষু চিকিৎসক চোখ সংগ্রহে বাধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? সিদ্ধার্থবাবুর কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তাকে অভিযোগ করেছিলাম। উনি কিছু না করলে কী করব?’’ স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ ব্যাপারে মন্তব্য করেননি।
দেখা যাচ্ছে, ২০১৪-১৫ বর্ষে ন্যাশনাল মেডিক্যালে সাকুল্যে ১২টি চোখ সংগৃহীত হয়েছে। এমআর বাঙুরে মিলেছে ২টি চোখ (বাঙুরে প্রকল্পে নিযুক্ত সংস্থা ইতিমধ্যে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। তাদের জায়গায় অন্য কাউকে নিযুক্তও করা হয়নি)। এসএসকেএম-এ পাওয়া গিয়েছে ২১৪টি, এনআরএস-এ ২৬৫টি চোখ। তুলনা করলে দেখা যাবে, কলকাতার যে দুই হাসপাতালে এই প্রকল্প ভাল চলছে, সেই আরজিকর ও ‘রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি’ (আরআইও)-তে চোখ সংগ্রহ বছরে মাত্র ১১০০টি।
চক্ষুদান আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মেডিক্যাল কলেজ বা জেলা হাসপাতালের স্তরের হাসপাতালে এক বছরে অন্তত ৫০০টি চোখও মিলছে না, এটা অভাবনীয়! চোখ সংগ্রহ কমতে কমতে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশে অষ্টম স্থানে। ২০১৪ সালে যেখানে রাজ্যে অন্তত ৬০০০ চোখ দরকার ছিল, সেখানে সংগৃহীত হয়েছে মোটে ৩০৩১টি চোখ।
আরআইও-তে চোখ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে ভাস্কর সিংহ বলেন, ‘‘সরকার কখনও কাউন্সেলরদের প্রশিক্ষণ বা সচেতনতা শিবির আয়োজন করেছে? চক্ষুদান নিয়ে ক’টা সরকারি বিজ্ঞাপন হয়? এখনকার মন্ত্রীরা কখনও প্রকাশ্যে চক্ষুদানে উৎসাহ দিয়েছেন?’’ নীলরতনের ‘অতুল বল্লভ’ চক্ষু ব্যাঙ্কের কথাই ধরা যাক। মধ্যমগ্রামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে চক্ষু সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চক্ষু চিকিৎসকদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে ২০১৩ থেকে তারা কাজ বন্ধ করে দেয়। তার পরে এত দিনেও অন্য কোনও সংস্থাকে সেখানে নিয়োগ করা হয়নি। ওই চক্ষু ব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক অনিল ঘাটার অভিযোগ, ‘‘২০১৩ থেকে এই নিয়ে চিঠি লিখে যাচ্ছি, রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর একটারও উত্তর দেয়নি।’’
এসএসকেএম ও ন্যাশনালে প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি নামী বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালের তরফে তাদের প্রশাসনিক প্রধান অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ন্যাশনালে মৃত রোগীর আত্মীয় বা চিকিৎসক, কেউ চক্ষুদানে আগ্রহী নন। এসএসকেএম-এ বেশিরভাগ দুর্ঘটনার কেস বা মেডিকো-লিগাল কেস আসে। পুলিশ ময়না-তদন্ত না করে দেহ ছাড়তে চায় না। তদন্ত করতে গিয়ে চোখ নষ্ট হয়ে যায়। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, সর্বত্র এমন নিয়ম আছে যাতে আগে চোখ তুলে নিয়ে দেহ ময়না-তদন্তে পাঠানো যায়। কিন্তু এ রাজ্যে এমন নিয়ম চালুতে সরকারের আগ্রহ নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy