Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
স্বঘোষিত দাদাদের দৌরাত্ম্যে ত্রস্ত শহরবাসী, প্রতিকার কি মিলবে?
Corruption

‘জরিমানা’ দিলে তবেই চলবে কারখানা

কাটমানি-বিতর্কের রেশ কাটার কয়েক মাসের মধ্যেই আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে জেলায় জেলায়।

দাদাগিরির কবলে এমনই কারখানার মালিকেরা। নিজস্ব চিত্র

দাদাগিরির কবলে এমনই কারখানার মালিকেরা। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২০ ০৩:৩৪
Share: Save:

এখন বেশি লোক রেখে নাকি কাজ করানো বারণ! তাই এক দিনে কত জন কাজ করছেন, মাথা গুনে গুনে তার হিসেব দিতে হবে কারখানার মালিককে। অভিযোগ, নিজে হিসেব মিলিয়ে দেখার পরে এলাকার দাদার তা মনঃপুত হলে তবেই মিলবে কারখানা চালানোর ছাড়পত্র! নয়তো শ্রমিকের মাথাপিছু হিসেবে প্রতিদিন ‘জরিমানা’ দিতে হবে কোথাও ২০, কোথাও বা ৩০ টাকা! মাথা যত বাড়বে, ‘জরিমানা’ও তত বেশি। যার জেরে দাদাকে দেওয়া প্রতিদিনের টাকার অঙ্কটা দাঁড়াচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা!

কাটমানি-বিতর্কের রেশ কাটার কয়েক মাসের মধ্যেই আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে জেলায় জেলায়। ‘আনলক’ পর্বে সব খোলার পরে কলকাতাতেও পাড়ার দাদারা আগের মতোই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ। শহরের ছোট-বড় কারখানার মালিকদের বক্তব্য, ‘দাদাদের জুলুম’ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। কারখানা তৈরি হওয়ার সময়ে এককালীন টাকা নেওয়ার পরেও এত দিন নানা ছুতোয় টাকা দাবি করতেন ওই দাদারা। কারখানার সামনে গাড়ি বা কোনও ব্যবসায়িক সামগ্রী রাখার জন্যও টাকা দিতে হত তাঁদের। পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেও কারখানা মালিকদের ‘দেখে দেওয়া’র নির্দেশ দিতেন ওই দাদারা। অভিযোগ, এর সঙ্গেই এখন যুক্ত হয়েছে করোনার ছুতোয় শ্রমিকের সংখ্যা বেশি বলে টাকা আদায়। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বড়বাজার, কুমোরটুলি, মানিকতলা, কাশীপুর, এন্টালি, তারাতলার মতো এক-একটি জায়গায় শ্রমিক রাখার ‘রেট’ এক-এক রকম। নির্দিষ্ট কোনও মাপকাঠি নেই। সবটাই নির্ভর করছে দাদার মর্জির উপরে।

দক্ষিণ কলকাতার বেঙ্গল ল্যাম্প বস্তি সংলগ্ন একটি ডালকলের মালিক জানালেন, সম্প্রতি পাড়ার এক দাদা তাঁর কারখানায় গিয়ে বলেছেন, “করোনার জন্য অনেক লোককে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করানো যাবে না। যদি কাজ করাতেই হয়, জরিমানা দিতে হবে।” মালিক বোঝানোর চেষ্টা করেন, আগের চেয়ে শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে এনেছেন। যত জনকে না-রাখলেই নয়, তত জনকে দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু দাদা বলেন, “আমার হিসেবে ১৬ জন বাড়তি। করোনা পুরোপুরি না যাওয়া পর্যন্ত এই ১৬ জনের জন্য প্রতিদিন মাথাপিছু ২০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। রোজ ৩০০ টাকা। তা হলেই পুলিশ-প্রশাসন আমি দেখে দেব। করোনা নিয়ে কেউ কিছু বলতে আসবে না।”

‘দেখে দেওয়া’র এই পুরনো রেওয়াজের হাত ধরে শহরে জনবসতির মধ্যেই এমন বহু কারখানা গজিয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ, যেগুলির সেখানে থাকারই কথা নয়। প্লাস্টিক পোড়ানো থেকে রাসায়নিকের ব্যবহার, ব্যাটারির কারখানা থেকে ঝাঁঝে পাড়া অতিষ্ঠ করে দেওয়া লঙ্কার গুঁড়োর কারখানাও রাতারাতি তৈরি হয়ে গিয়েছে কোনও বিধি না মেনেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, বার বার জানিয়েও সাড়া মেলেনি পুলিশ-প্রশাসন থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। মানিকতলা মেন রোডে গাড়ির ব্যাটারি তৈরির কারখানা করে এখন বিপদে পড়েছেন এক ব্যক্তি। বললেন, “যে দাদা জমি দেখে দিয়ে ন’বছর আগে মোটা টাকা নিয়ে কারখানা করিয়ে দিলেন, তিনিই এখন বলছেন, লোকালয়ে কারখানা রাখা যাবে না। এ কথা বলে মাসিক ব্যবস্থায় টাকা নেওয়ার খাতা খুলতে চাইছেন তিনি।”

বেলেঘাটায় আবার তোলা দিতে না চাওয়ায় একটি কারখানার মূল গেট আটকেই সৌন্দর্যায়নের সরকারি প্রকল্পের কাজ হয়েছিল। তা নিয়ে বিতর্কও হয় চলতি বছরের শুরুতে। ওই ব্যবসায়ীর দাবি, “এখন দাদা বলছেন, তাঁর তিনটে ছেলেকে কাজে নিতে হবে। না-হলে যত জন আমার কাছে কাজ করছেন, সকলের করোনা পরীক্ষা করিয়ে ফাঁসিয়ে দেবেন।”

ওই পাড়ার দাদাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সকলেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেন বললেন, “এই মাত্রায় অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে কারও কোনও অভিযোগ থাকলে তিনি দলকে জানাতে পারেন। সালিশি সভা তো আর হয় না, এখন পুলিশ সব দেখে দেয়।”

নারকেলডাঙা চাউলপট্টির এক কাঠের ব্যবসায়ী বললেন, “তোলা দিতে না চাওয়ায় যে দিন পাড়ার দাদার সঙ্গে ঝামেলা হল, তার পরের দিনই আমাদের গুদামের দরজা ভেঙে চুরি হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেওয়ার ছ’মাস পরেও কেউ ধরা পড়েনি। কার কাছে অভিযোগ করব? দাদার বিরুদ্ধে কথা বললে কোথায় কোথায় খবর পৌঁছয়, সকলেই তো জানেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Corruption Extortion TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE