Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নেতারা ভোটে, রক্তদানে খরা পাড়ায় পাড়ায়

ভোট মরসুমে পাড়ার নেতাদের এই ব্যস্ততার জন্যই ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি বেকায়দায় পড়েছে বলে খবর। কারণ, বছরভর ওই নেতারাই সবচেয়ে বেশি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে থাকেন।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫৭
Share: Save:

রক্তদান শিবিরের জন্য মধ্য কলকাতার কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে কথা বলতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের কয়েক জন প্রতিনিধি। দুপুর থেকে স্থানীয় এক কার্যালয়ে তাঁদের বসিয়ে রেখে বিকেলের দিকে পাড়ার নেতা এসে বললেন, ‘‘এখন কী করে করি? ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে তো! তবে কথা দিচ্ছি, ২৩ মে-র পরে আপনার রক্তদান শিবিরের কোটা আমি একাই পূর্ণ করে দেব। আমার পাড়া থেকেই অন্তত চারটে শিবির হবে।’’

ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা বলার চেষ্টা করেন, চার মাস আগে তাঁরাই তো চিঠি লিখে রক্তদান শিবির করার আবেদন জানিয়েছিলেন। মাঝপথে কথা থামিয়ে ওই নেতার এক সহযোগী বিরক্ত মুখে বললেন, ‘‘দেখছেন তো ভোট চলছে। এখন ও সব হবে না। পরে দেখা করবেন। দাদার এখন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই।’’

ভোট মরসুমে পাড়ার নেতাদের এই ব্যস্ততার জন্যই ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি বেকায়দায় পড়েছে বলে খবর। কারণ, বছরভর ওই নেতারাই সবচেয়ে বেশি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে থাকেন। তাতেই ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির মাসিক লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগটা পূর্ণ হয়। তবে গরমের সময়ে শিবিরের সংখ্যা অনেক কমে যায়। তার সঙ্গে এ বার যুক্ত হয়েছে লোকসভা ভোট। সব মিলিয়ে এপ্রিলের শুরু থেকে শহরে হওয়া রক্তদান শিবিরের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। আগামী মাসের শেষে ভোটের ফল ঘোষণা হতে হতে সেই সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে, সেটাই এখন বড় আশঙ্কা ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রিজিওনাল ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টারের ডিরেক্টর মধুসূদন মণ্ডল বলেন, ‘‘রক্তদান শিবিরগুলিতে রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরাই রক্ত দেন বেশি। কিন্তু, এই ভোটের সময়ে তাঁদের পাওয়া যাবে না। গরমে এমনিই শিবির কম হয়, তার উপরে রাজনৈতিক দলের সমর্থকেরাও সময় দিতে পারছেন না।’’ এর মধ্যেই আবার দমদমে উদ্যোক্তাদের পছন্দ না হওয়ায় ছেলে পাঠিয়ে রক্তদান শিবির বন্ধ করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সেখানকার এক তৃণমূল কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। রক্ত-সঙ্কটের মুহূর্তে জনপ্রতিনিধির ওই পদক্ষেপে নিন্দার ঝড় উঠেছে সব মহলে।

এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ভবনের এক সূত্র জানাচ্ছেন, সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, রাজ্যের প্রতিটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে রোজ ৩০ ইউনিট, সাব ডিভিশনাল হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে ৫০ ইউনিট, জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে ১০০ ইউনিট এবং মডেল ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে ৩০০ ইউনিট রক্ত থাকলে পরিস্থিতি সামলানো যাবে। কিন্তু ভোট মরসুমে সেই রক্তের জোগান ঘিরেই দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, প্রতি মাসে অন্তত ১৫-২০ হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করেন তাঁরা। এর জন্য মাসে ১০০টি শিবির করার লক্ষ্যমাত্রা থাকে তাঁদের। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি থেকে এখনও পর্যন্ত হওয়া রক্তদান শিবিরের সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছয়নি। একই চিত্র শহরের অন্যান্য ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে।

এই রক্তশূন্যতার পথে যাওয়া আটকাতে এখন অন্য রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য ভবন। তাদের তরফে ইতিমধ্যেই রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রধান সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা দফতরের সঙ্গেও আলাদা করে এ বিষয়ে কথা বলছে স্বাস্থ্য ভবন। ভোটের বাজারে পাড়ার নেতাদের পাওয়া না গেলে ক্লাব এবং স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের দিয়ে রক্তদান করানোর পরিকল্পনা করছেন তাঁরা।

স্বাস্থ্য ভবনের যুগ্ম অধিকর্তা (ব্লাড সেফটি) স্বপন সরকার বলছেন, ‘‘গরম এবং ভোট মিলে সমস্যা হচ্ছে। গত বছর মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তখন পুলিশকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মীরা রক্ত দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার ভোটের জন্য তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুল-কলেজ এবং ক্লাবগুলিকে উৎসাহিত করা ছাড়া উপায় নেই।’’ রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের গভর্নিং বডির সদস্য অচিন্ত্যকুমার লাহা অবশ্য বলছেন, ‘‘রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকে এই সময়ে সামাজিক কাজটা ভুলে যান। তাঁদের মনে রাখা উচিত, রাজনীতি কিন্তু সমাজের বাইরে নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE