রক্ষণাবেক্ষণ: এপিসি রায় রোড সংলগ্ন কবরস্থানে আব্দুল মজিদ। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
পূর্ব পুরুষেরা এখানেই শুয়ে আছেন। এখানেই কোথাও, গভীর মাটির নীচে। এমনিতে মানিকতলা মার্কেট সংলগ্ন ব্যস্ততম এপিসি রায় রোডের উপরে যে এমন ছায়া ঘেরা জায়গা রয়েছে, তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কবরস্থানগুলিতে ঘুরে ঘুরে ফুল দিচ্ছিলেন বছর চুয়াত্তরের আব্দুল মজিদ। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি কবর খোঁড়ার কাজে এসেছিলেন। বর্তমানে নাখোদা মসজিদের অধীনস্থ কবরস্থানের দেখভাল করেন তিনি। যিনি জানেন না, তাঁর মৃত্যুর পরে ছেলেরা এই কাজে আসবেন কি না। নিজের দুই ছেলে স্টিলের আলমারি বানানোর কাজ করেন।
মজিদ বলছিলেন, ‘‘ওদের মন যদি চায়, তা হলে এ কাজ করবে। না হলে নয়!’’ আজ, রবিবার ভোট। মানিকতলার এক বুথে ভোট দিতে যাবেন তিনি। ভোটের ক্ষেত্রেও নিজের মন যা বলবে, তা শুনতেই বিশ্বাসী। ‘‘ধরুন আপনি এক জনকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন। আমি অন্যকে। মন যাঁকে চায়, ভয় না পেয়ে তাঁকেই ভোট দেওয়া উচিত।’’— বলছিলেন মজিদ।
অর্ধশতক ধরে এখানকার মাটি খুঁড়ে মৃতদের নিশ্চিন্তে শোয়ানোর ব্যবস্থা করছেন মজিদ। তাঁর কথায়, ‘‘দেখুন মাটি খোঁড়ার তো কোনও নিয়ম নেই। কিন্তু মৃতদেহ আনা এবং কবরস্থানের নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার নিয়ম রয়েছে! যেমনটা শ্মশানেও আছে আর কী!’’ ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হওয়া নিয়ে চারদিকে এত শোরগোল। সব কিছু ছাপিয়ে ধর্মই যেন প্রাধান্য পাচ্ছে, ঢেকে দিচ্ছে সব দিক, অথচ মজিদের কথায় তার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই! অক্লেশে বলছিলেন, ‘‘একই তো নিয়ম সব জায়গায়।’’
যে নিয়ম মেনে ভোটেও সারা দিন খোলা থাকবে পিস হেভন। ‘‘মৃত্যু তো দিনক্ষণ দেখে আসে না। তাই পিস হেভন খোলাই থাকবে।’’ কথাগুলো বলছিলেন জাস্টিন নাগেল, পিস হেভনের অন্যতম মুখপাত্র। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ চলছে। একশো বছরের পুরনো বিল্ডিংয়ের মতোই সে আইনি বিবাদও পুরনো। এমনিতে পিস হেভনের সঙ্গে অগুনতি ভিআইপি-র নাম জড়িয়ে রয়েছে! ‘‘এটাই আমাদের প্রধান সমস্যা জানেন তো! সকলে ভাবেন যে পিস হেভন শুধুমাত্র ভিআইপি-দের জন্য। এটা সাধারণ মানুষের জন্যও।’’ আক্ষেপ নাগেলের। এই মুহূর্তে কফিন তৈরির ব্যস্ততা চলছে। নাগেল জানালেন, শুধু তো দেশেই নয়, কোনও বিদেশি যদি এখানে কাজে বা ঘুরতে এসে মারা যান, তা হলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস তাঁদের সঙ্গেই যোগাযোগ করে। তখন কফিনবন্দি করে তাঁরাই সেই মৃতদেহ সে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। নাগেল বলছিলেন, ‘‘বর্তমানে ১১টি চেম্বার রয়েছে। অনেক সময়ে সেগুলো পুরো ভর্তি হয়ে যায়, অনেক সময়ে ফাঁকা থাকে।’’
ব্যস্ত: পিস হেভনে সেখানকার কর্মীরা। নিজস্ব চিত্র
‘‘কোনও ঠিক নেই। কখনও খুব চাপ থাকে। এখন যেমন একটু কম। তবে দিনে গড়ে ১০-১২টা শব তো আসেই।’’ —বলে উঠলেন রাজকুমার মল্লিক। নিমতলা শ্মশানে ডোমের সহকারী বছর চল্লিশের রাজকুমার শনিবার দুপুরে শবদাহের কাজে ব্যস্ত। দূষণমুক্ত কাঠের চুল্লিতে তখন আগুন জ্বলছে। বাইরে মৃতদের পরিবার-পরিজন। তার মধ্যেই একটু বিশ্রাম। ভোটের কথা বলতেই রাজকুমার বললেন, ‘‘ধর্ম-টর্ম বুঝি না। যিনি ভাল কাজ করবেন, তাঁকেই ভোট দেওয়া উচিত।’’ জোড়াবাগানের বাসিন্দা রাজকুমার বলছিলেন, ‘‘ভোট দিতে আর কত ক্ষণ লাগে! কিন্তু ভোট কাকে দিচ্ছি, সেটাই বড় কথা। ভোট দিয়েই এখানে কাজে চলে আসব।’’ ছুটি নেওয়ার উপায় নেই। কারণ, ডোমের সংখ্যা কম। আগে যেখানে ২৪ জন ডোম ছিলেন, এখন মাত্র ১২ জন কাজ করছেন। এ দিকে শবদাহের চাপও বাড়ছে। ‘‘বলুন, এটাও তো একটা সমস্যা! রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই দাবিও তো থাকে।’’ রাজকুমারের যুক্তি।
ছোট ছোট দাবি। কারও দাবি শান্তির, কারও কাজের, কারও শৃঙ্খলার, কারও অন্য কিছুর। সেই দাবি মেটার প্রত্যাশা নিয়েই এ দিন বুথমুখী শহরের ভোট-জনতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy