Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Vidyasagar College Vandalization

‘হীরক রাজার নিশানাও তো ছিল শিক্ষাঙ্গনই’

মূর্তি নয়, এই আঘাত আসলে বাঙালির সংস্কৃতির উপরেই। এমনই ভাবছে শহরের নবীন প্রজন্ম।শিক্ষাক্ষেত্রে তো বারবারই আঘাত হানছে বিজেপি। মানবীবিদ্যার চর্চা তুলে দিতে চায় এই দল।

ধিক্কার: বিদ্যাসাগর কলেজে ভাঙচুরের প্রতিবাদে পোস্টার। বুধবার, শ্যামবাজার মোড়ে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ধিক্কার: বিদ্যাসাগর কলেজে ভাঙচুরের প্রতিবাদে পোস্টার। বুধবার, শ্যামবাজার মোড়ে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৯ ০১:২৬
Share: Save:

আদৃতা দে ঘটক
(যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল-এর প্রাক্তন ছাত্রী)

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেদ ও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়ে তার পরে বিদ্যাসাগর সই স‌ংগ্রহ করতে নেমেছিলেন। বিধবা বিবাহ প্রচলনের লড়াইটা শুরু হয়েছিল এ ভাবেই। বিজেপি হয়তো তাঁকে এই কারণেই ভয় পায়। এক জন মানুষ, যিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পারদর্শী অথচ তাঁর জীবন, কর্ম কিছুই বিজেপির

‘হিন্দুত্ব’-র সঙ্গে খাপ খায় না। বিজেপি শুধু ভারত বিরোধীই নয়, শিক্ষা বিরোধীও। বিদ্যাসাগর তো শুধু এক জন মানুষ নন, তিনি একটি আদর্শ। সেই আদর্শের মার নেই আজও। নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নের রাস্তাটা তিনিই দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েদের আসল জায়গা রান্নাঘর— বিজেপির নেতাদের মুখে এমন কথা শুনতে হয় আজও। পিছিয়ে নেই বিজেপির নেত্রীরাও। যে দল ‘সংস্কারী’, ভীরু নারীকেই ‘আদর্শ ভারতীয় নারী’ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে প্রতি পদে, তাদের কাছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বড় শত্রু আর কে আছে? ব্রাহ্মণ, সংস্কৃত পণ্ডিত, অথচ নারী স্বাধীনতার পক্ষে! নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এক বিধবা নারীর! অতএব গুঁড়িয়ে দাও তাঁর মূর্তি।

শিক্ষাক্ষেত্রে তো বারবারই আঘাত হানছে বিজেপি। মানবীবিদ্যার চর্চা তুলে দিতে চায় এই দল। কারণ সেই মতবাদের সঙ্গে বিজেপির মতবাদ খাপ খায় না কোনও ভাবেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ তকমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। আর মানুষ ভুল বুঝছেনও। যখন ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙা হল, তখন বামদলগুলি ছাড়া তেমন ভাবে প্রতিবাদ করেননি কেউ। যেন প্রতিবাদ করলেই গায়ে কমিউনিস্ট ছাপ পড়ে যাবে। কিন্তু সে দিনই বোঝা উচিত ছিল, এই আঘাত অন্যত্রও আসবে। মানবীবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে খুব ভয় পাই। আশঙ্কা হয় নারী-দলিত-মুসলমান-আদিবাসীদের মতো সংখ্যালঘুরাই শুধু নন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই দলের হাতে এক সময়ে আক্রান্ত হবেন সকলেই।

মনীষা নস্কর

(রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী)

গোপাল বড় সুবোধ বালক, রাখাল বড় খারাপ। গোপাল সবার ভালবাসা পায়। আর রাখাল?

তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, ‘রাখালকে কেহ ভালবাসে না। কোনও বালকেরই রাখালের মতো হওয়া উচিত নয়’। শিশুবয়সে ভাল-মন্দের ফারাক বোঝার বোধটুকুর যিনি জন্ম দিয়েছিলেন, আজ জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তির মুখে দাঁড়িয়ে সেই মানুষটিরই এত লাঞ্ছনা! দেশ গড়ার বার্তা দেয় যারা, তারাই ‘বোধোদয়’-এর লেখকের মূর্তি ভেঙে প্রমাণ করে দিল তাদের শিক্ষা এবং বোধ স্রেফ ঘুরে মরে ধর্মের অন্ধ গলিপথে।

মঙ্গলবার বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের রোড শো থেকে নিশানা করা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত কলেজকে। ‘রাম’-এর নামে স্লোগান দিতে দিতে শিক্ষার, নারী অধিকারের প্রতীক বিদ্যাসাগরের মূর্তিটি টুকরো টুকরো করেছেন বিজেপি সমর্থকেরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে এই তাণ্ডবলীলা চালানোর পরেও এঁরা সভ্য সমাজের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেবেন?

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

যে বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করছি, তার শুরুটা হয়েছিল বিদ্যাসাগরের লেখা ‘বর্ণপরিচয়’-এর হাত ধরে। আমার স্কুলে বিদ্যাসাগরের মূর্তিতে প্রণাম করে তবে ক্লাসে ঢুকতাম। কেউ জোর করেনি। তা-ও করতাম। কারণ একটাই— শ্রদ্ধা। এই শ্রদ্ধা, আবেগ নিয়ে যদি কেউ ছিনিমিনি খেলতে আসে, তখন তাকে বর্বরের বেশি কিছু মনে হয় না।

বিদেশি শত্রুরা বারবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছে। আক্রমণের ধরনটা সবারই প্রায় এক। যে কোনও জাতির সবচেয়ে বড় অবলম্বন তার সংস্কৃতি। অতএব, আঘাত হানো সেখানেই, যাতে তাদের জোরের জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যায়। এখন আমাদের দেশেই বেড়ে উঠেছে বিভীষণেরা। ত্রিপুরায় লেনিন, তামিলনাড়ুতে পেরিয়ার, মেরঠে অম্বেডকর, কেরলে গাঁধী, কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি ভাঙার পরে এ বার বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর কলেজেরই ছাত্র প্রয়াস

চন্দ যেমন বলছিলেন— ‘এমন কাজ যারা করতে পারে, তারা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। হীরক রাজার নিশানাও তো ছিল শিক্ষাঙ্গনই।’

ঋতঙ্কর চৌধুরী

(বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র)

মঙ্গলবার রাত আটটা নাগাদ যখন ঘটনার কথা জানতে পারলাম তখন প্রথমে বিশ্বাস করিনি। বিদ্যাসাগর কলেজ আমাদের কাছে মন্দিরের মতো। সেই মন্দির কী ভাবে তছনছ করা হচ্ছে, তা টিভিতে দেখে শিউরে উঠছিলাম। বিদ্যাসাগরের মূর্তি টুকরো টুকরো হয়ে কলেজের উঠোনে পড়ে আছে। এই লজ্জা কোথায় রাখব? বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙতে ওদের কারও হাত কাঁপল না? টিভিতে আমাদের কলেজে ওই তাণ্ডবলীলা দেখে রাতে ভাল করে ঘুম হয়নি।

টিভিতে তাণ্ডব দেখতে দেখতেই ফোন করেছিলাম বন্ধু সন্দীপন, কৌশিক, শ্রেয়সীকে। ওদের বলি, এর প্রতিবাদ করতে হবে। তবে কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতায় তলায় নয়, আমরা এই প্রতিবাদ করব নিজেদের মতো করে।

গত বছরই আমরা এই কলেজ থেকে পাশ করেছি। এই কলেজের বহু শিক্ষকের সঙ্গে এখনও আমাদের খুব ভাল যোগাযোগ আছে। অনেক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও রয়েছে। শিক্ষকদের ফোন করায় ওঁরা বললেন, ‘বুধবার চলে এসো কলেজে। দেখে যাও তোমাদের কলেজে কেমন তাণ্ডব চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা’। তাই বন্ধুদের ফোন করে আজ সকালেই কলেজে চলে এসেছি। আরও কিছু বন্ধুকে ফেসবুকে, হোয়াটস্‌অ্যাপের মাধ্যমে ডেকেছি। ওরাও আসবে কলেজে।

আমরা ঠিক করেছি, শিক্ষকদের বলব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদ্যাসাগরের ওই মূর্তি আবার তৈরি করে আগের জায়গায় বসানো হোক। কলেজে তাণ্ডব চালানোয় বহু টাকার জিনিসপত্রও নষ্ট হয়েছে। আমাদের সামান্য যেটুকু সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে আমরা কলেজকে আর্থিক সাহায্য করতে রাজি আছি। আমাদের কলেজ যত দিন না আগের অবস্থায় ফিরে আসে, যত দিন না বিদ্যাসাগরের নতুন মূর্তি আগের জায়গায় ফিরে আসে, তত ক্ষণ আমরা কোনও ভাবেই স্বস্তি পাব না। নিজের ঘরে কেউ যদি এই ভাবে আঘাত হানে, তা হলে কি স্বস্তি পাওয়া যায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE