দেখা: সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষের সঙ্গে রূপান্তরকামীরা। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
কাস্তে হাতুড়ি তারার রংটা কি শুধুই লাল? সেটা কি কখনও রামধনু হতে পারে না?
কিংবা বামপন্থীদের মূল দাবিগুলির ভিড়ে কি দেওয়ালে পিঠ ঠেকা যৌন সংখ্যালঘু সমাজের দাবিও মিশে যেতে পারে না?
এই প্রশ্নগুলোও এ বার উঠে এল ভোট-প্রচারের ময়দানে। রবিবার বিকেলে রিপন স্ট্রিটের একটি ছাপাখানার পাশে হলঘরে যৌন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মুখোমুখি হয়ে যখন বসলেন কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষ। দেশ জুড়ে মানুষের ইচ্ছেমতো খাওয়া, পরার অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের থেকে ব্যক্তিগত যৌন রুচির অধিকারটাও যে আলাদা নয়, তা বলতে অবশ্য দ্বিধা করেননি তিনি।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অপরাধের তকমামুক্ত হওয়ার পরে প্রথম লোকসভা ভোট! নানা স্তরেই উঠে আসছে সমকামী-রূপান্তরকামী-তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের নাগরিক অধিকারের দাবি। কংগ্রেস, বিজেপি-র মতো দলও ইস্তাহারে রূপান্তরকামীদের ক্ষমতায়নের কথা বলছে। সিপিএমের ইস্তাহারে সমলিঙ্গের সম্পর্ককে স্বীকৃতি, সমপ্রেমীদের সম্পত্তি, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকারের মতো বিষয়ও উঠে এসেছে। তবু সমাজের নানা স্তরে যৌন সংখ্যালঘু বা এলজিবিটিকিউআইএ গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণাও বহমান। এ সব স্পর্শকাতর বিষয়ে মাথা ঘামালে বেশির ভাগ ভোটারের মনেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। সেই ভয়ে এখনও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন বহু ভোটপ্রার্থীই। কনীনিকা তবু সোজা ব্যাটেই যাবতীয় সংশয়ের মুখোমুখি হলেন। ভোটের এক মাস আগে প্রার্থীর সঙ্গে এমন মেলামেশার উদ্দেশ্য বা সার্থকতা নিয়েও অনেকের চোরা সন্দেহ মিশে ছিল বৈকী! কনীনিকা বললেন, ‘‘এত দাবি, অধিকারের লড়াই— কোনওটাই রাতারাতি ১৯ মে মিটমাট হয়ে যাবে না। একসঙ্গে লড়াইটা জারি রাখাই আসল।’’ কাল, মঙ্গলবার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেশের দিনেও যৌন সংখ্যালঘু সমাজের বন্ধুদের পাশে থাকার খোলাখুলি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কনীনিকা। স্পষ্ট বলেছেন, আক্ষরিক ভাবেই কাউকে পাশে নিয়ে চলতেই তাঁর সমস্যা নেই।
কলকাতার জোরদার গরমে দুপুরের কিছুটা সময়ই এখন সাধারণত বিশ্রাম পাচ্ছেন ভোটপ্রার্থীরা। দিনভর প্রচারে দৃশ্যতই ক্লান্ত কনীনিকা তবু দুপুরের ফাঁকটুকুই আলাদা ভাবে যৌন সংখ্যালঘু সমাজের সঙ্গে মিশবেন বলে বেছে নিয়েছিলেন। মূলত কার কী দাবিদাওয়া শোনার মন নিয়েই এই সভায় হাজির হয়েছিলেন সিপিএমের গুটিকয়েক কর্মী। রাজ্য সরকারের ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ড থাকলেও তা শিশু ও মহিলা কল্যাণ দফতরের অন্তর্গত হওয়ায় রূপান্তরকামীদের সমস্যা অনেকাংশে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রূপান্তরকামী সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিংহের। ঘরে-বাইরে দিশেহারা রূপান্তরকামী প্রবণতার কিশোর-কিশোরীদের দুর্দশা বা পরে রূপান্তরের জন্য অস্ত্রোপচারের নানা সমস্যার কথাও উঠে আসছিল। সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সমকামী-রূপান্তরকামী-তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের ঠিকঠাক জনসুমারি হওয়াও দরকার।’’ পরিবারের নিগ্রহের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে বালুরঘাটের সমকামী যুবক বিনন্দন সরকার রবীন্দ্রনাথের লাইন মনে করালেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’! হাততালিতে ভরে উঠল হলঘর।
এসএফআই-এর রাজ্য কমিটির সদস্য অপ্রতিম রায় শোনালেন, তিনি নিজেও সমকামী হওয়া সত্ত্বেও কখনও দলের ভিতরে ছিটেফোঁটা
অপমান-বৈষম্যের মুখে পড়েননি। সমকামী, রূপান্তরকামী কমরেডদের গুরুত্ব দলে বাড়ছে বলে দাবি এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাসের। এ দেশের ভোটের ভবিষ্যতে দলিত বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মতোই সমকামী-রূপান্তরকামীরা কি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন? এমন একটা সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানালেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy