Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রভাব খাটিয়েই বারবার নাগালের বাইরে কাদের

প্রেমিকা ডাকসাইটে সুন্দরী এক অভিনেত্রী। তাঁর সঙ্গেই শ্যুটিং ফ্লোরে দিব্যি ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত সুদর্শন ছেলেটাকে। কিন্তু তার নামে যে অপরাধমূলক কাজকর্মের লম্বা অভিযোগের তালিকা ঝুলছে, টালিগঞ্জের প্রায় কেউই সেটা আঁচ করতে পারেননি।

শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

প্রেমিকা ডাকসাইটে সুন্দরী এক অভিনেত্রী। তাঁর সঙ্গেই শ্যুটিং ফ্লোরে দিব্যি ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত সুদর্শন ছেলেটাকে। কিন্তু তার নামে যে অপরাধমূলক কাজকর্মের লম্বা অভিযোগের তালিকা ঝুলছে, টালিগঞ্জের প্রায় কেউই সেটা আঁচ করতে পারেননি। তত দিন, যত দিন না পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে ওই অভিনেত্রীর প্রেমিকের নামটাই উঠে এল। তখন থেকেই একটু একটু করে জানা যেতে লাগল কাদের খান নামে ওই সুদর্শন যুবকের কীর্তিকলাপ।

এক পুলিশকর্তা জানালেন, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের অনেক আগে থেকেই তোলাবাজি, হুমকি, প্রতারণা-সহ একাধিক অভিযোগ ছিল কাদেরের বিরুদ্ধে। পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা ২০১২-য়। পুলিশের রেকর্ড বলছে, তার পাঁচ বছর আগেই এক বার গ্রেফতার হয়েছিল কাদের। ২০০৭-এ খিদিরপুরের এক দুষ্কৃতীকে ধরতে গিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছিলেন তার কথা। সে বার বালিগঞ্জের এক ধাবা থেকে পাকড়াও করা হয়েছিল কাদেরকে। পরে থানা থেকে জামিন পায় সে।

কিন্তু ওই এক বারই। আর কখনও গ্রেফতার হয়নি কাদের। কেন? গোয়েন্দারা বলছেন, কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহসটাই কারও ছিল না। তার নিজের দলবল তো ছিলই, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসাও ছিল। এমনকী পুলিশের একাংশের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল কাদেরের।

পার্ক সার্কাসের নর্থ রেঞ্জ এলাকায় কাদেরদের বিশাল তিনতলা বাড়ি। চর্মজাত দ্রব্য রফতানির ব্যবসা ও শিল্পে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা রয়েছে তাদের। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘বড়লোকের বখাটে ছেলে বলতে যা বোঝায়, কাদের একেবারেই তা-ই।’’ এক দিকে ভবানীপুর, শেক্সপিয়র সরণি, বেনিয়াপুকুর এলাকায় দলবল নিয়ে তোলাবাজি চালাত সে। অন্য দিকে ‘শিকার’ ধরতে নিয়মিত হানা দিত পার্ক স্ট্রিটের নাইট ক্লাবগুলোয়!


সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন...

উদ্দেশ্যটা ‘রোজগারই’, তবে ধরন আলাদা। পুলিশ-সূত্র জানাচ্ছে, নাইট ক্লাবে আসা ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাত কাদের ও তার দলবল। পরে তাদের নিয়ে যেত অবৈধ নানা বিনোদনের ঠেকে। সেখানে নানা ভাবে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিত। তার পর শুরু হতো সেই ‘বিনোদনের’ কথা মনে করিয়ে ব্ল্যাকমেল এবং টাকা আদায়। এমনই এক নাইট ক্লাব থেকেই লিফ্‌ট দেওয়ার নাম করে সুজেট জর্ডনকে গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করেছিল তারা।

এবং কাদের কতটা প্রভাবশালী, এর পরেই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল কলকাতা পুলিশের গুণ্ডাদমন শাখা। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে কাদেরের ভাই নাসের-সহ তিন জন প্রথমে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এর পরেই কলকাতা ছেড়ে চম্পট দেয় কাদের। পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে অভিনেত্রী প্রেমিকাকে ফোন করেছিল সে। গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি, ওই ফোনের রেকর্ড ধরে খুঁজে জানা যায়, মুম্বইয়ে লুকিয়ে আছে কাদের। তাকে ধরার জন্য পত্রপাঠ মুম্বই রওনা হয়ে যায় গোয়েন্দাদের একটি দল। গিয়ে দেখে, পাখি উড়েছে!

মুম্বইয়ে গোয়েন্দারা তার গোপন ডেরায় পৌঁছনোর মিনিট দশেক আগেই সেখান থেকে চম্পট দিয়েছিল কাদের। কী করে এমন হল? লালবাজারের এক কর্তা বললেন, ‘‘ভেতর থেকে খবর বেরিয়ে না গেলে এ ভাবে হাতছাড়া হতো না কাদের। এতেই বোঝা যায়, কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল সে!’’

মুম্বই থেকে ফিরতে না-ফিরতেই অন্য একটি মোবাইলের সিমকার্ডের সূত্র ধরে বিহারে কাদেরের গতিবিধি নজরে আসে গোয়েন্দাদের। কিন্তু সেখান থেকেও ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয় তাঁদের। এক পুলিশকর্তা জানালেন, ‘‘২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোতিহারি, ধানবাদ, নাসিক, গোয়া, শিলিগুড়ি ও মিরিকে কাদেরের খোঁজে বিভিন্ন হোটেল ও পরিচিতদের ডেরায় হানা দিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। কিন্তু খোঁজ মেলেনি তার।’’ শেষ পর্যন্ত গত বছরের গোড়ায় তদন্তকারীরা জানতে পারেন, কাদের প্রথমে ছিল বাংলাদেশে। পরে সে নেপালে আশ্রয় নেয়। এর আগেই যদিও কাদেরের খোঁজে নেপালের পাটনে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু লাভ হয়নি।

এখন সে কোথায়? লালবাজারের একাংশের দাবি, পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশে কাদের ডেরা বানিয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। অন্য একটি অংশের দাবি, প্রতিবেশী একটি দেশের পাসপোর্ট নিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে কানাডায় রয়েছে কাদের। তবে যেখানেই থাকুক না কেন, এ রাজ্য থেকে কাদেরের কাছে হাওয়ালা মারফত নিয়মিত টাকা যে পৌঁছচ্ছে, তার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

তার হাত যে লম্বা, পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতেও তার প্রমাণ দিচ্ছে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kader khan absconding park street gang rape
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE