Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Majerhat

অনেক সেতুর অবস্থাই খারাপ, বললেন মুখ্যমন্ত্রী, তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ মেট্রোর কাজ

শুধু তদন্ত কমিটি নয়, রাজ্যের সমস্ত সেতুতে নজর রাখার জন্য ‘ইনস্পেকশন অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ও গঠন করার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৩৪
Share: Save:

সেতু নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়ল ক্যাবিনেট বৈঠক শেষ হতেই। মাঝেরহাটে সেতু ভাঙার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ক্যাবিনেট বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠক সেরে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, রাজ্যের অনেক সেতুর অবস্থাই খারাপ, কারণ সেগুলির আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গিয়েছে। কোন সেতুর অবস্থা কেমন, সে দিকে নিয়মিত নজর রাখতে ইনস্পেকশন অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মাঝেরহাটের বিপর্যয়ের কারণ খতিয়ে দেখতে গড়ে দিয়েছেন তদন্ত কমিটিও। সেই কমিটির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঝেরহাটে মেট্রোর কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী এ কথাও জানিয়েছেন।

বুধবার সন্ধ্যায় দার্জিলিং থেকে ফিরেই মুখ্যমন্ত্রী সর্বাগ্রে গিয়েছিলেন মাঝেরহাট। বৃহস্পতিবার তিনি ক্যাবিনেট বৈঠক করেছেন। সেতু বিপর্যয় নিয়ে কথা বলতে এবং রাজ্যের অন্য সেতুগুলির বিষয়ে আলোচনা করতেই ওই বৈঠক ডাকা হয়েছিল। বৈঠক শেষ করে নবান্নেই সাংবাদিক সম্মেলন করেন মুখ্যমন্ত্রী। মাঝেরহাট সেতুর বিপর্যয় প্রসঙ্গে বুধবার তিনি যা বলেছিলেন, এ দিনও সেই কথাই বলেন। মেট্রো রেলের কাজের জন্য সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে মুখ্যমন্ত্রী জানান, আগে থেকে কোনও সিদ্ধান্তে সরকার পৌঁছচ্ছে না। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরেই সেতু ভাঙার কারণ নিয়ে সরকার মুখ খুলবে।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এ দিন বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে। কী কী কারণে রাজ্যের বিভিন্ন সেতু দুর্বল হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘২০ চাকার ট্রাক আমাদের কোনও কাজে লাগে না। ওই ট্রাকগুলো রাস্তা ঘষে ঘষে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিজগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। পুলিশকে বলে দিয়েছি, ২০ চাকার ট্রাক চলতে দেওয়া যাবে না।’’

২০ চাকার ট্রাককে দুষে মুখ্যমন্ত্রী মূলত কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করতে চেয়েছেন বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। প্রয়োজনে বন্দর কর্তৃপক্ষ রেলপথ ব্যবহার করুন বা জলপথে পণ্য পরিবহণ করুন। কিন্তু বাংলার রাস্তায় ২০ চাকার ট্রাক আর চলতে দেওয়া হবে না, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।

আরও পড়ুন: পূর্ত দফতরের গাফিলতিতেই এত বড় দুর্ঘটনা, মত বিশেষজ্ঞের

শুধু ২০ চাকার ট্রাকের জন্যই কি মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ল? তেমন কোনও মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রী করেননি। তবে তাঁর ইঙ্গিত, রাজ্যের বিভিন্ন সেতু দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ওই ভারী ট্রাকগুলি।

মাঝেরহাট সেতু কেন ভাঙল, তা খতিয়ে দেখার জন্য যে কমিটি মুখ্যমন্ত্রী গড়ে দিয়েছেন, তার মাথায় রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব মলয় দে। তাঁর নেতৃত্বে আজ থেকেই কমিটি কাজ শুরু করছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। তবে যত ক্ষণ না কমিটির তদন্ত শেষ হচ্ছে, তত ক্ষণ মেট্রোর কাজ বন্ধ থাকবে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মেট্রো রেলকে কাজ বন্ধ করতে বলেছি। কারণ আমাদের ফরেন্সিক পরীক্ষাও করতে হবে।’’

আরও পড়ুন: এক বছর অবহেলায় আটকে মাঝেরহাটের ৩ কোটির সংস্কার

শুধু তদন্ত কমিটি নয়, রাজ্যের সমস্ত সেতুতে নজর রাখার জন্য ‘ইনস্পেকশন অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ও গঠন করার কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন। সেই কমিটি সব ব্রিজের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবে বলে তিনি জানিয়েছেন। কাদের নিয়ে কমিটি গঠিত হবে, তা মুখ্যসচিব স্থির করবেন বলেও জানিয়েছেন মমতা।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘কোনও ব্রিজ পূর্ত দফতরের অধীনে, সেচ দফতরের অধীনে কিছু সেতু রয়েছে, কিছু রয়েছে কেএমডিএ-র হাতে। তাই পূর্ত দফতর, সেচ দফতর এবং কেএমডিএ-র অধীনে আলাদা আলাদা ইনস্পেকশন অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি হচ্ছে।’’

পুরনো সেতুগুলির নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না বলেও এ দিন মুখ্যমন্ত্রী ফের অভিযোগ করেছেন। পোস্তায় যে নির্মীয়মাণ উড়ালপুল ভেঙে পড়েছিল, সেই উড়ালপুলের কাগজপত্র পেতেও সমস্যা হয়েছে বলে তিনি জানান। ওই উড়ালপুল ফের তৈরি করা হবে, নাকি ভেঙে ফেলা হবে, তা স্থির করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু কমিটি এখনও রিপোর্ট দেয়নি বলে জানিয়েছেন মমতা। বিশেষজ্ঞ কমিটির কাজ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘দু’বছর ধরে এক্সপার্টরা রিপোর্ট দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই। এখনও রিপোর্ট জমা পড়েনি।’’

আরও পড়ুন: গ্রামে প্রস্তুত কনে, শহরে ধ্বংসস্তূপের তলায় প্রণব

মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে, অনেক সেতুরই আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গিয়েছে। কোনটা কবে তৈরি হয়েছিল, আয়ুষ্কাল কত দিন, সে সব অবিলম্বে খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা হচ্ছে। ২০টি ব্রিজের আয়ুষ্কাল বা কর্মক্ষম থাকার মেয়াদ শেষ বলে তিনি জানতে পেরেছেন, বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সাঁতরাগাছি সেতু, উল্টোডাঙা সেতু, ঢাকুরিয়া সেতু, শিয়ালদহ সেতু-সহ বেশ কয়েকটি সেতুর নামও তিনি জানিয়েছেন। সাঁতরাগাছি সেতুতে অবিলম্বে ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, সাঁতরাগাছি সেতু দিয়ে এখন মূলত যাত্রিবাহী গাড়ি চলবে। ভারী গাড়ি চলতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘‘আমাকে তো ব্রিজগুলো বাঁচাতে হবে। এতগুলো একসঙ্গে দু্র্বল হয়ে গিয়েছে শুনছি। গত ১০০ বছর কেউ খোঁজ রাখেনি। এখন সব ক’টা একসঙ্গে খারাপ হলে তো মুশকিল।’’ ব্রিজ ভাঙলে তা নতুন করে তৈরি করার বা মেরামত করার জন্য টাকার অভাব হবে না মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন। কিন্তু এত সেতু একসঙ্গে নষ্ট হলে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থায় বড়সড় সমস্যা হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ বার থেকে ভারী গাড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চলেছে পুলিশ।

রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সেতু নির্মাণ শেষ হতেই কিছু লোক সেতুর তলায় ঢুকে জায়গা দখল করছে এবং ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘এঁরা কিন্তু কেউ স্থানীয় লোক নন। অন্য কোনও জায়গা থেকে এসে ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করছেন। ব্রিজের নীচেই রান্না করছেন, থাকছেন, খাচ্ছেন, আগুন জ্বালাচ্ছেন।’’ এতেও সেতুর ক্ষতি হচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশকে বলেছি, সব ব্রিজের তলা ক্লিয়ার করে দিতে।’’

বেআইনি দখলদার বা দোকানদারদের কারণে অনেক সেতুর মেরামতি সম্ভব হচ্ছে না,—জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিয়ালদহ উড়ালপুলে মেরামতি করতে গেলে দোকানদাররা বাধা দিচ্ছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি।

তবে মাঝেরহাটের দুর্ঘটনা কার জন্য ঘটল, তা এত তাড়াতাড়ি বলা সম্ভব নয়, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলে তবেই বলা যাবে— মন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পূর্ত দফতরের দিকে যে ভাবে আঙুল উঠেছে, নাম না করে এ দিন তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদমাধ্যমের একাংশ আগে থেকে কারও কারও ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ সব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে তিনি ইঙ্গিত দেন। তাঁর কথায়, ‘‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আপনারা মিডিয়া ট্রায়াল করবেন না।’’ এমন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সংবাদমাধ্যম মতামত নিচ্ছে, যাঁকে কিছু দিন আগে অকর্মণ্যতার জন্য রাজ্য সরকার সরিয়ে দিয়েছে— মন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে মাঝেরহাট সেতু কার গাফিলতিতে বিপর্যয়ের মুখে পড়ল, তা নিয়ে এ দিনও স্পষ্ট করে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলতে চাননি। বলেছেন, ‘‘যদি কারও কর্তব্যে গাফিলতি হয়ে থাকে, তা হলে তাঁর শাস্তি হবে।’’

(কলকাতার ঘটনা এবং দুর্ঘটনা, কলকাতার ক্রাইম, কলকাতার প্রেম - শহরের সব ধরনের সেরা খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE