সেতুর ধারে গাছ, কোথাও কংক্রিট খসে বেরিয়ে এসেছে ইস্পাতের কাঠামো। এমনই হাল দুর্গাপুর সেতুর।
এক দিকে চেতলা, অন্য দিকে নিউ আলিপুর। মাঝখানে মাঝেরহাটের মতোই খাল এবং রেললাইন।
এই দুই এলাকা জুড়তে বামফ্রন্ট আমলেই তৈরি করা হয়েছিল দুর্গাপুর রেল ওভারব্রিজ। মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পর, সেখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে তারই সমান্তরাল এই দুর্গাপুর ব্রিজই এখন বিকল্প। বেহালা-ঠাকুরপুকুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে কলকাতা যাতায়াতের জন্য এই সেতুই এখন মূল ভরসা।
কিন্তু, এই সেতু অতিরিক্ত ভার বহনে আদৌ কতটা প্রস্তুত?
বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্গাপুর ব্রিজের চেতলার দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন দু’জন ট্রাফিক সার্জেন্ট। তাঁদের দাবি, সকাল ছ’টায় ডিউটি শুরু করেছেন। তখন বেলা দেড়টা। সেই সময় থেকে এখনও এক বারও নড়তে পারেননি। এত গাড়ির চাপ! বেলা দু’টোর সময়ে দেখা গেল, গড়ে প্রতি মিনিটে সেতু পেরোচ্ছে প্রায় দেড়শো চার চাকার গাড়ি এবং শ’দুয়েক মোটর সাইকেল। কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের হিসাবে দুপুর দুটো মোটেও ব্যস্ত সময় বা পিক আওয়ার্স নয়। ব্যস্ত সময়ে এই সংখ্যাটাই দ্বিগুণ হয়ে যায়।
পঁচিশ বছরেরও কিছু বেশি সময় আগে এই সেতু চিরাচরিত পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। বিশেষজ্ঞদের পরিভাষায় ‘রিইনফোর্সড কনক্রিট ব্রিজ’ (আরসিবি) পদ্ধতি। যেখানে লম্বায় এবং আড়ে গার্ডার ব্যবহার করা হয়।পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘সেই সময়কার রীতি অনুসারে ৭০ টন ভার বহন করার মতো উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল এই সেতু।’’ তিনি আরও বলেন, “মাঝেরহাট সেতুর থেকে বয়সে অনেক তরুণ এবং কাঠামোগত ভাবে আধুনিক এই ব্রিজের স্বাস্থ্য এখনও যথেষ্ট ভাল।”
কিন্তু, কতটা ভাল সেই স্বাস্থ্য?
এ দিন দেখা গেল, গোটা সেতুতে রঙের প্রলেপ। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, বয়সের তুলনায় অনেক বেশি চকচকে ও তরুণ। সেতুর দু’পাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে, সেতুর গায়ে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য গাছ। তার মধ্যে অধিকাংশই বট-অশ্বত্থ। এই গাছগুলো দ্রুত অনেক গভীর পর্যন্ত শিকড় চারিয়ে ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই শিকড় এক দিকে যেমন কাঠামোতে ফাটল ধরায়, একই সঙ্গে শিকড় দিয়েই সেতুর কংক্রিটের কাঠামোর গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায় জল। সেতুর স্বাস্থ্যের জন্য এই জল অতি বিপজ্জনক।
দুর্গাপুর সেতুর উপরেই গজিয়ে গিয়েছে বট গাছ।—নিজস্ব চিত্র।
সেতুর উপর কয়েক জায়গায় দেখা গেল বিটুমিন এবং অ্যাসফল্টের আস্তরণ ধুয়ে মূল কংক্রিটের কাঠামো বেরিয়ে পড়েছে। সেতুর দু’ধারে তাকালেই চোখে পড়ে একাধিক জায়গায় কংক্রিট খসে গিয়েছে। উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে ইস্পাতের কাঠামো। সেই কাঠামো চুঁয়ে চুঁয়ে বৃষ্টির জল পৌঁছচ্ছে সেতুর কাঠামোর গভীরে। সেটাও তো সেতুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, “এমনিতে কংক্রিট বেরোলে ক্ষতির কোনও কারণ নেই। কিন্তু, সেই কংক্রিটের আস্তরণ সরে গিয়ে যদি পরের স্তরে থাকা ইস্পাতের কাঠামো উন্মুক্ত হয়ে যায়, তবে তা সেতুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।” কারণ, তাতে সেই ইস্পাতে মরচে ধরে ও সেতু দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, ‘‘এই জলই সেতুর সবচেয়ে বড় শত্রু। সে জন্য আধুনিক সব সেতুতেই জল নিকাশির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’
আরও পড়ুন: উদ্ধার হল ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে থাকা আরও একটি মৃতদেহ
সেতুর বিটুমিন এবং অ্যাসফল্ট আস্তরণ এভাবেই উঠে গিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে কংক্রিট।— নিজস্ব চিত্র।
দুর্গাপুর সেতুতেও জল নিকাশির জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেতুর মূল রাস্তার দু’ধারে একাধিক পিট (গর্ত) করা হয়েছিল যাতে বৃষ্টির জল না জমে নীচে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, বাস্তবে মাত্র দু’টি এ রকম গর্তের মুখ খোলা অবস্থায় পাওয়া গেল। বাকিগুলো মাটির আস্তরণে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তাই সেতুর ঢাল দিয়েই বৃষ্টির জল নামছে। যেখান থেকে মূল কাঠামোতে জল ঢুকে সেতুর ক্ষতি করার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন: পূর্ত দফতরের গাফিলতিতেই এত বড় দুর্ঘটনা, মত বিশেষজ্ঞের
সেতুর দু’ধার ধরে এমনই অবস্থা।—নিজস্ব চিত্র।
বিশেষজ্ঞেরা যদিও আশ্বাস দিচ্ছেন, দুর্গাপুর সেতুর স্বাস্থ্য এখনও যথেষ্ট ভাল। কিন্তু, প্রাথমিক তদন্তের পর তাঁরা মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয়ের পেছনে যে ‘রোগ’গুলি আবিষ্কার করেছেন, তার সব উপসর্গই রয়েছে দুর্গাপুর সেতুর শরীরে। বিশেষজ্ঞদের মতে অবিলম্বে সেই ‘রোগনির্ণয়’ করে চিকিৎসা না করালে, সামনের দিনে এই অতিরিক্ত ভার বইতে বইতে মাঝেরহাট সেতুর মতোই ক্নান্ত হয়ে পড়বে বয়সে তরুণ এই দুর্গাপুর সেতু। কারণ, এতটা অতিরিক্ত ভার বা লোড-বেয়ারিংয়ের কথা ভেবে সেই সময়ে এই সেতু নির্মাণ করা হয়নি।
সেতুর ক্লান্তি বাড়লে যে কী হয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ মাঝেরহাট বিপর্যয়!
(কলকাতার ঘটনা এবং দুর্ঘটনা, কলকাতার ক্রাইম, কলকাতার প্রেম - শহরের সব ধরনের সেরা খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy