মাঝেরহাট সেতুর একাংশ ভেঙে তৈরি হয়েছে এমনই ফাটল।
মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি মেয়েকে ফোন করেছিলেন বাবা। কারণ রোজ বাসে চেপে ওই সেতু দিয়েই কলেজ থেকে ভবানীপুরে বাড়ি ফেরেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রান্তিকা গোস্বামী। ভিডিয়ো কল করেছিলেন তাঁর উদ্বিগ্ন পরিজনেরা। কেউ এক জন কলটি ধরেন। দেখা যায়, দু’পা সামনে ছড়িয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে রয়েছেন প্রান্তিকা। কথা বলার ক্ষমতা নেই তাঁর। হাওড়া-রবীন্দ্রনগর রুটের যে মিনিবাস-সহ সেতুটি ভেঙে পড়ে, তাতেই ছিলেন প্রান্তিকা। কাঁধে ও পায়ে চোট পান তিনি। স্থানীয়েরা তাঁকে উদ্ধার করলে এসএসকেএমে নিয়ে আসা হয় প্রান্তিকাকে। পরে তিনি জানান, সেতু ভেঙে পড়ছে বুঝতে পেরে আতঙ্কে বাস থেকে ঝাঁপ দেন। কিন্তু সেতুর ভাঙা অংশের সঙ্গে নীচেই পড়ে যান।
মঙ্গলবার বিকেলে সেতুর একাংশ ভেঙে পড়ার পর থেকেই একবালপুরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোম এবং এসএসকেএমে বাড়তি তৎপরতা শুরু হয়। উপচে পড়ে আহতদের পরিজনেদের ভিড়। প্রিয়জনদের ফোনে না পেয়ে অনেকেই চলে আসেন ওই দুই হাসপাতালে।
দুর্ঘটনার পরেই এসএসকেএমে ইমার্জেন্সি এলাকা দ্রুত ফাঁকা করে দেওয়া হয়। যে সমস্ত রোগী সেখানে ছিলেন তাঁদের সাময়িক ভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেন কর্তৃপক্ষ। আহতদের দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে ইমার্জেন্সির বাইরে সারি দিয়ে রাখা হয় চাকা লাগানো স্ট্রেচার। হাসপাতালে কোনও রোগী এলেই চিকিৎসক ও নার্সরা দৌড়ে এসে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, ‘মাঝেরহাট?’ গোটা হাসপাতাল জুড়ে তখন আতঙ্কিত মুখের ভিড়।
এসএসকেএমে আহত প্রান্তিকা গোস্বামী। মঙ্গলবার।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এসএসকেএমে মোট ১৩ জনকে আনা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে এক যুবককে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। তার পরে অন্য আহতদের পরিজনেদের মধ্যে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম সৌমেন বাগ (২৭)। তিনি বেহালার শীলপাড়ার বাসিন্দা। চার জন এখনও এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে নজরুল মোল্লা নামে এক ব্যক্তির একাধিক হাড় ভেঙে গিয়েছে। তিনি আইটিইউ-তে ভর্তি। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এক নির্মাণসংস্থার কর্মচারী অবধেশ পাণ্ডে জানান, সেতুর তলায় তাঁদের অস্থায়ী অফিস রয়েছে। এ দিন সেতু ভেঙে পড়ার সময়ে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময়টুকুও পাননি। কোমরে, কাঁধে আঘাত পেয়েছেন তিনি। মেদিনীপুরের বাসিন্দা গুরুপদ জানা নামে আর এক কর্মী তখন ঘুমোচ্ছিলেন। আচমকা জেগে দেখেন, চাপা পড়েছেন ধ্বংসস্তূপের তলায়। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা।
আরও পড়ুন: ‘আমি ভাঙা সেতুর নীচে আটকে, বাঁচান ভাইজান’
আরও পড়ুন: প্রকাণ্ড সেতুটা ঝুলে রয়েছে ‘ভি’-এর আকারে
একবালপুরের ওই নার্সিংহোম সূত্রের খবর, অ্যাম্বুল্যান্সে করে ১৮ জন আহতকে নিয়ে আসা হয়। তার মধ্যে ছ’জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসাধীন ১২ জনের মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এক জনকে আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানান, আহতদের অধিকাংশেরই শরীরের একাধিক হাড় ভেঙে গিয়েছে। কারও আবার মুখের হাড়ও ভেঙেছে।
তবে বরাত জোরে বেঁচে ফিরেছেন বেশ কয়েক জন। তাঁদের মধ্যে এক জন, হাসিনুর রহমান মোল্লা জানান, স্কুটিতে শ্বশুরকে নিয়ে মহেশতলার সন্তোষপুর থেকে কলকাতায় আসছিলেন তিনি। সেতুতে খানিকটা উঠেছিলেন। হঠাৎই স্কুটিটি তীব্র গতিতে নীচে নামতে থাকে। এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসিনুর জানান, কী হয়েছে প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি। পরে বুঝতে পারেন, সেতুর একাংশ ভেঙে পড়েছে। হাসিনুর বলেন, ‘‘আমি স্কুটি ছাড়িনি। শক্ত করে ধরে বসেছিলাম। তার পরে ধাক্কা লেগে উল্টে যায় স্কুটিটি।’’ আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন দু’জনেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুই হাসপাতালে ভিড় আরও বাড়তে থাকে। হিমাংশু চৌধুরী নামে এক পড়ুয়া বলেন, ‘‘সেতুর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ মনে হল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে। পুরো নীচে এসে পড়লাম। দেখলাম, পাশে কয়েক জন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন।’’ একবালপুরের নার্সিংহোমে বসে এক আহত দেবাশিস পাল জানান, সামনে থেকে সেতু ধসে যেতে দেখে শিউরে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এই আতঙ্ক কি কাটবে কোনও দিন?’’
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক ও নিজস্ব চিত্র।
(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy