Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Madan Mitra

বাইরে অভিষেক, ভিতরে অভিমান, মদন বলছেন, ‘বস ইজ় নেভার রং’

আবার ‘প্রাক্তন’ শব্দটা বুঝিয়ে দেয়, সাপলুডোও কম খেলতে হয়নি ভবানীপুর মিত্র বাড়িতে সকাল থেকে ‘দরবার’ খুলে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকা মদন মিত্রকে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৮ ১৩:৪২
Share: Save:

ছবিটা দেখলে এখন আর চেনা যায় না মুখটা। প্রায় তিন দশক আগের সাদাকালো ছবি। ১৯৯০ সাল। এসএসকেএম হাসপাতালের বেডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। যে হাতটা অক্ষত, সেটা ধরে বসে রয়েছেন অশক্ত প্রবীণ প্রফুল্ল সেন, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দু’পাশে বরকত গনি খান চৌধুরী এবং অশোককৃষ্ণ দত্ত। আর পিছনে রোগাটে চেহারার দুই তরুণ। এক জনের নাম কানন, এক জনের নাম মদন।

দু’জনের কেউই আর রোগাটে নেই। দু’জনের কেউই আর ওই ছোট্ট নাম দু’টোয় পরিচিত নন। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বা রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র— এখন এ ভাবেই বলা হয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক উত্থানটা কেমন হয়েছে, সে আঁচ করাই যায়। আবার ‘প্রাক্তন’ শব্দটা বুঝিয়ে দেয়, সাপলুডোও কম খেলতে হয়নি ভবানীপুর মিত্র বাড়িতে সকাল থেকে ‘দরবার’ খুলে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকা মদন মিত্রকে।

সদর দরজার সামনে ফি সকালের এই ভিড় মিত্র বাড়িতে নতুন নয়। এই ভিড় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে জমতে শুরু করেছে, এমনও নয়। বহু বছরের ভিড়। কিন্তু এই ভিড় সরেও গিয়েছিল কয়েকটা বছর আগে, সদর দরজা সুনসান হয়ে গিয়েছিল। কারণ মদন মিত্র নিজেই বাড়িটাতে ছিলেন না, ছিলেন জেলে।

নিজের অফিসঘরে এই ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন মদন মিত্র।

১৯৯০ সালের সাদাকালো ছবিটা রাখা রয়েছে মদনের পরিপাটি অফিস ঘরটায়। ছবিটার কথা উঠতেই সপ্রতিভ হয়ে ওঠেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। সোৎসাহে চিনিয়ে দিতে থাকেন— ইনি অমুক, তিনি তমুক, ওটা শোভন, এটা আমি। তার পরেই একটু ম্রিয়মান হয়ে আসে গলা, কণ্ঠস্বরকে যেন ছুঁয়ে যায় অভিমান— ‘‘বাংলা বন্‌ধের দিনে হাজরা মোড়ে সিপিএমের গুন্ডারা মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তখন তিনি সাংসদও নন, জোর করে হারিয়ে দিয়েছিল যাদবপুরে। যুব কংগ্রেস সভানেত্রীও নন...।’’ আরও কিছু যেন বলার ছিল মদন মিত্রের। কিন্তু বলেন না, গিলে ফেলেন চট করে।

দেখুন সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার:

ভিডিয়ো: মৃণালকান্তি হালদার।

কথায় কথায় মদন জানালেন, এক দিনে তিনটে সভা রয়েছে, ২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে, ছুটতে হবে সে দিকেই। এখন রোজই এই রকম ছুটছেন মদন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে। এই মদন মিত্রই কিন্তু ঠিক এক বছর আগের ২১ জুলাইতে সমাবেশ মঞ্চে উঠতে পারেননি। বিস্তর ফিসফাস চলেছিল তা নিয়ে। কিন্তু মদন নিজে সে সব নস্যাৎ করছেন এখন। বলছেন, ‘‘মিছিল করে আসছিলাম, ঘামে পাঞ্জাবি পুরো ভিজে গিয়েছিল, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম রাস্তায়, পাঞ্জাবিতে কাদা লেগে গিয়েছিল। ওই অবস্থায় কেউ মঞ্চে ওঠে? আমি ইচ্ছা করেই উঠিনি।’’

আরও পড়ুন- শাহ-দর্শনার্থীরা রাতারাতি কালীঘাটে​

আরও পড়ুন- ফেরাতেই হবে প্রবেশিকা,যাদবপুরে অনশন শুরু পড়ুয়াদের​

এ বার মঞ্চে উঠবেন তো? তৃণমূল যুব কংগ্রেসের উদ্যোগে সমাবেশ, আর আপনি এখন তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতির ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। দুঁদে রাজনীতিক জবাব দিতে গিয়ে ভেঙে নিলেন প্রশ্নটাকে। প্রথমে বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই থাকব। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে খুব ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, সম্মান করেন।’’ তার পরে বললেন, ‘‘বৃত্ত কিন্তু আমাদের দলে একটাই— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই বৃত্ত, তিনিই কেন্দ্রবিন্দু।’’ হতে পারেন মমতা দলের কেন্দ্রবিন্দু। অভিষেক তো দলের ভবিষ্যৎ। সিনিয়র নেতারা ডায়মন্ড হারবারের সভায় মাইক ফুঁকে বলে এসেছেন সে কথা। সামান্য থমকালেন মদন। বললেন, ‘‘এই মুহূর্তে গোটা ভারতে যত যুব সংগঠন রয়েছে, সে সব সংগঠনের সভাপতি পদে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সবার মধ্যে সেরা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ কী ভাবে সেরা অভিষেক? মদনের ব্যাখ্যা, ‘‘মার্জিত, রুচিশীল, সংস্কৃতিবান, পরিণত রাজনীতিক, কর্পোরেট স্টাইল, উঁচু তলা থেকে একেবারে নীচের তলার কর্মী, সকলের মধ্যে সমান জনপ্রিয়— অভিষেক ছাড়া আর এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’’

তখন তিনি জেলে। -নিজস্ব চিত্র।

অভিষেক সম্পর্কে বলতে বলতেই আবার মমতায় ফেরেন প্রাক্তন পরিবহণ মন্ত্রী। তিনি গ্রেফতার হওয়া মাত্রই কে পথে নেমে মিছিল করেছিলেন? মমতা। অনেক ‘ষড়যন্ত্র’ সত্ত্বেও কে গোটা দলকে তাঁর পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন? মমতা। তিনি জেলে থাকা সত্ত্বেও কে তাঁকে কামারহাটিতে টিকিট দিয়েছিলেন? মমতা। বলে চলেন মদন। কিন্তু শুধু টিকিট দিলেই কি কাজ শেষ? আপনি জেলে থাকা সত্ত্বেও কোনও বড় নেতা আপনার হয়ে কামারহাটিতে প্রচারে যাননি কেন? মদন বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। ঠিক আমার কেন্দ্রে নয়। উনি যেখানে সভা করেছিলেন, সেটা বরাহনগরে পড়ে। কিন্তু বরাহনগর-কামারহাটির জংশন ওই জায়গাটা।’’ এর পরেই ফের যেন সামান্য অভিমানী ‘মমতার সৈনিক’। বলেন, ‘‘বাকিদের আমি নিয়ে যেতে পারিনি, সে আমার দুর্ভাগ্য।’’

তা হলে কি জল্পনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন? জেল থেকে বেরিয়ে আসা মদন মিত্রকে তৃণমূল ভবনে পুনর্বাসন দিলেও, আগের মতো কাছে আর টানেননি মমতা। এমনই গুঞ্জন গোটা রাজ্যে। কিন্তু গত কয়েক মাসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনেকটাই বেড়েছে মদনের। সাংসদ হিসেবে নিজের কাজের খতিয়ান প্রকাশ করার অনুষ্ঠানে মদন মিত্রকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছেন অভিষেক। পুরুলিয়ায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ যাঁদের বাড়িতে ‘জনসম্পর্ক’ করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের কলকাতায় এনে তৃণমূলে সামিল করার সাংবাদিক বৈঠকে মদন মিত্রকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন অভিষেক। ২১ জুলাইতে শহিদ স্মরণের প্রস্তুতি হিসেবে নানা এলাকায় সভা করার দায়িত্ব মদন মিত্রকে দিয়েছেন অভিষেক।

দলীয় বৃত্ত থেকে যিনি ছিটকে গিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছিল, সেই মদন মিত্র আবার ধাপে ধাপে দলে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপোর হাত ধরে— এই চর্চাকে এর পরেও নস্যাৎ করবেন? পোড় খাওয়া রাজনীতিক আবার কৌশলী। বললেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন এই দলের সব। আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রধান সেনাপতি। মদন মিত্র সৈনিক। সৈনিক তো সেনাপতির নির্দেশেই কাজ করবেন।’’

দলে নিজের বর্তমান অবস্থান নিয়ে মদন মিত্র তা হলে সন্তুষ্ট? স্পষ্ট জবাব মেলে না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েক দশকের সঙ্গীর বাক্যে। বলেন, ‘‘আমার দেওয়ালে দু’টো লাইন লেখা রয়েছে। প্রথমটা হল— বস ইজ় নেভার রং। আর দ্বিতীয় লাইন হল— ইফ দ্য বস ইজ় রং, দেন সি দ্য ফার্স্ট লাইন।’’

অভিমানের এমন সংযত প্রকাশ হয়? সেই সংযমেরই কি মূল্য ফিরে পাচ্ছেন মদন মিত্র, এখন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE