Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

শব্দবাজি ফাটিয়ে মনোবিদের চেম্বারে

বাজির বিকট শব্দে অন্যকে চমকে দেওয়ার আনন্দে কালীপুজো বা দীপাবলির রাতে যাঁরা মাতোয়ারা থাকেন, তাঁদের একটা অংশ পুজো মিটলে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক অবসাদের শিকার হন।

বিপদ: শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে ক্ষতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। ফাইল চিত্র

বিপদ: শব্দ ও আলোর ঝলকানিতে ক্ষতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। ফাইল চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩১
Share: Save:

বাজির বিকট শব্দে অন্যকে চমকে দেওয়ার আনন্দে কালীপুজো বা দীপাবলির রাতে যাঁরা মাতোয়ারা থাকেন, তাঁদের একটা অংশ পুজো মিটলে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক অবসাদের শিকার হন। কখনও কখনও পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, তাঁদের দেখা মেলে মনোরোগ চিকিৎসকের চেম্বারে। কখনও অবসাদ, আবার কখনও এক ধরনের মানসিক বিকৃতি জন্ম নেয় তাঁদের মধ্যে। শব্দদৈত্যের আক্রমণের এই নতুন চেহারা ইদানিং সামনে আসছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ও শব্দ গবেষকদের একটা বড় অংশ। তাঁরা বলছেন, যাঁরা শব্দবাজি ফাটান, তাঁদের বিপদও কিছু কম নয়। অন্যকে বিপাকে ফেলে আনন্দ পাওয়ার মানসিক বিকৃতি থেকেই তাঁরা এ কাজ করেন। কিন্তু আকস্মিক আওয়াজে একই ভাবে তাঁদেরও শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়।

স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার উপরে শব্দবাজি কতটা ক্ষতিকারক, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই তথ্য তিন বছর আগে জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছে পেশও করেছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেই কমিটির রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করেই এ রাজ্যে শব্দবাজির মাত্রা ৯০ ডেসিবেল পর্যন্ত বাঁধা হয়েছিল। শব্দদূষণের গবেষক-চিকিৎসকেরা সে সময়ে সুপারিশও করেছিলেন, ওই কাজ ধারাবাহিক ভাবে করা উচিত, যাতে সারা দেশে শব্দবাজির মাত্রাকে ৯০ ডেসিবেল হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও এর পরে বিষয়টি নিয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি।

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, শব্দবাজির ফলে শুধু যে শারীরিক ক্ষতি হয় তা নয়, মানসিক ভাবেও অস্থিরতা তৈরি হয়। শ্রবণযন্ত্রের সমস্যার পাশাপাশি রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধির হার অনেক সময়ে এতটাই অস্বাভাবিক হয় যে, অতর্কিত আওয়াজে হাইপারটেনশনের রোগীদের রক্তচাপ বেড়ে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। যাঁরা শব্দবাজি ফাটাচ্ছেন, তাঁদেরও আকস্মিক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের যুক্তি, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে যাঁরা শব্দবাজি ফাটান, তাঁদের কোনও ক্ষতি হতে পারে না। কারণ, শব্দদূষণ সংক্রান্ত গবেষণা বলছে, নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি শব্দ সকলের উপরেই একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তা শুধু শরীরে নয়, মনেও।

আরও পড়ুন: রকসিডে রক্ষে নেই, দোসর ব্ল্যাক ক্যাটও

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্যতম সদস্য কনসালট্যান্ট নিউরোটোলজিস্ট অনির্বাণ বিশ্বাসের কথায়, ‘‘শব্দবাজি যাঁরা ফাটান ও যাঁরা তা শুনতে বাধ্য হন— অতর্কিত শব্দ তাঁদের উভয়েরই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ভেঙে দেয়। কারণ, যাঁরা শব্দবাজি ফাটান তাঁরা তো আর অতিমানব নন। দীপাবলির পরে অনেকেই আমাদের কাছে শ্রবণযন্ত্রের সমস্যা, মানসিক অস্থিরতা-সহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসছেন। এঁদের অনেকেই কিন্তু নিজেরা বাজি ফাটিয়েছেন। এ ভাবে তাঁরা এক ধরনের ‘স্যাডিস্টিক প্লেজার’ পান। না হলে হঠাৎ আওয়াজ কারও কাছেই আনন্দের কারণ হতে পারে না।’’

ওই বিশেষজ্ঞ কমিটির আরেক সদস্য ইএনটি চিকিৎসক শান্তনু পাঁজা বলেন, ‘‘দীপাবলির পরে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অনেকেরই শ্রবণশক্তি সাময়িক হারিয়ে যায়। এমনকি স্থায়ী ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। শিশু ও বয়স্কদেরই সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়।’’

ওই কমিটির চেয়ারম্যান ইএনটি চিকিৎসক দুলালচন্দ্র বসু জানাচ্ছেন, পরীক্ষার সময়ে দেখা গিয়েছিল, ডেসিবেল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে ১২০-১৩০-এ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। নাড়ির গতিও বেড়েছিল উদ্বেগজনক ভাবে। দুলালবাবুর কথায়, ‘‘শব্দবাজির তাণ্ডব আমাদের শরীরে কর্টিসল হরমোন ক্ষরণের মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়ে দেয়। তীব্র আওয়াজ শরীরের ভিতরে একটা ইমার্জেন্সি সিস্টেমকে সক্রিয় করে দেয়, যা খুবই ক্ষতিকারক।’’ কর্টিসল হরমোনের ক্ষরণ বেশি হলে কী হতে পারে? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এটি এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন। তীব্র শব্দে এর ক্ষরণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ক্ষরণে বুক ধড়ফড়ানি, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়, এমনকি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত পর্যন্ত হতে পারেন।

মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘শব্দবাজির কারণে সব থেকে বেশি ক্ষতি হয় যাঁরা বাজি ফাটান। তাঁরা বায়ু, শব্দ এবং আলো— তিনটি দূষণেরই শিকার হন। শব্দবাজির ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছয়। ফলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা তো থাকেই। পাশাপাশি আলোর তীব্র ঝলকানিতে চোখের রেটিনার ক্ষতিও হতে পারে।’’

বিভিন্ন মনোবিদের চেম্বারেও কালীপুজোর পরে মানসিক অস্থিরতা নিয়ে ভিড় করেন অনেকে। এঁদের একটা বড় অংশকে অবসাদে ভুগতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার বাজি ফাটিয়ে অন্যকে কতটা বিপাকে ফেললেন সেই হিসেব কষতে গিয়ে মানসিক বিকৃতির শিকার হন। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলেন,

‘‘এমনিতেই শহরে আওয়াজ বেশি থাকে, যা যথেষ্ট মানসিক চাপ তৈরি করে। কিন্তু কালীপুজো, দীপাবলির সময়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর শব্দবাজি, সেই সঙ্গে মাইকের আওয়াজ চলতেই থাকে। সব কিছু মিলিয়ে বিরক্তি, উদ্বেগ, অবসাদ এই সময়ে অনেকটাই বেড়ে যায়।’’

বিশেষজ্ঞেরা এ-ও জানাচ্ছেন, শহরে শব্দ ছড়িয়ে পড়ার কোনও জায়গা না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। শান্তনুবাবুর কথায়, ‘‘অলিগলিতেই বেশি ফাটানো হয় শব্দবাজি। ফলে দুই দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়া মূল শব্দের প্রতিধ্বনি বেশি ক্ষতি করে। আর সেটাই সব থেকে চিন্তার কারণ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Diwali Psychologist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE