মারধরের পরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঋতম। নিজস্ব চিত্র
গায়ে নীল টি-শার্ট। মারের চোটে কোমর থেকে খুলে যাওয়া জিনস পায়ের কাছে জড়ো হয়ে রয়েছে। হাসপাতালের গাড়িবারান্দায় লোহার খাটের পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা যুবক তখনও কাতরাচ্ছেন। উপস্থিত চিকিৎসক-পড়ুয়াদের হাতেপায়ে ধরে বলছেন, ‘‘আর মারবেন না। মরে যাব। আর এখানে আসব না। ছেড়ে দিন।’’ কেউ শুনছেন না তাঁর কথা। তাঁরই খুলে নেওয়া বেল্ট দিয়ে আরও কয়েক ঘা দেওয়ার পরে জানতে চাওয়া হল, বাড়ি কোথায়? কতগুলো চুরি করেছিস আগে?
বৃহস্পতিবার সকালে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের জে বি রায় স্টেট আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোবাইল চোর সন্দেহে এ ভাবেই গণপিটুনির শিকার হলেন এক যুবক। খবর দেওয়া হয়নি পুলিশকেও। পরে উল্টোডাঙা থানার পুলিশ জখম যুবককে উদ্ধার করে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, বছর বাইশের ওই যুবকের নাম ঋতম কুশারি। বাড়ি বাগবাজারের নন্দলাল বসু লেনে।
এ দিনের ঘটনায় ফের প্রমাণিত, দেশের শীর্ষ আদালত গণপিটুনি নিয়ে একাধিক বার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও বাস্তব চিত্রটা বদলায়নি। সম্প্রতি গণপিটুনি নিয়ে রাজ্যগুলিকে সতর্ক করার পাশাপাশি কেন্দ্রকে আইন তৈরির কথা বললেও বন্ধ করা যায়নি আইনকে হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। ২০১৪ সালে একই ভাবে মোবাইল চোর সন্দেহে এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রাবাসে কোরপান শাহ নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রেও অভিযোগ ছিল হবু চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। তবে এ দিন অবশ্য বড় অঘটন ঘটার আগেই পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করতে পারে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিককে চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘‘কোরপান খুনে চিকিৎসকেরা এখনও জেল খাটছেন। আপনাদের হুঁশ নেই?’’ এ দিন পুলিশ অবশ্য চুরির অভিযোগে পরে ঋতমকে গ্রেফতার করে। কোর্টে তোলা হলে তাঁর ১৪ দিনের জেল হেফাজত হয়। আর ওই যুবককে যাঁরা পেটালেন বলে অভিযোগ, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা করার কথা ভাবছে।
আরও পড়ুন: খাটের তলায় শিশুর দেহ, ধৃত মা
পুলিশ এবং ওই হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন সকালে হাসপাতাল লাগোয়া হস্টেলে ‘চোর চোর’ চিৎকার শোনা যায়। দেখা যায়, চিকিৎসক-পড়ুয়া শুভজিৎ রায় এবং বিপুল বিশ্বাস এক যুবকের পিছনে ছুটছেন। তাঁদের চিৎকারে যুবককে ধরে ফেলেন স্থানীয়েরা। ঋতম নামের ওই যুবককে হাসপাতালের গাড়িবারান্দায় নিয়ে গিয়ে শুরু হয় গণপিটুনি। যুবকের বেল্ট দিয়েই তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। মারের চোটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। শুভজিতের দাবি, ‘‘আমার মোবাইল ফোন নিয়ে ছেলেটা পালাচ্ছিল। আমরা ধরেছি। তবে মারিনি। হাসপাতালের বাইরের লোকজন মেরেছে।’’ একই দাবি বিপুলেরও।
আরও পড়ুন: পরীক্ষা ভন্ডুল করতে স্কুলে তাণ্ডব ছাত্রদের
তবে ছেলেকে চোর সন্দেহে মারধর করা হয়েছে জেনেও বিব্রত নন ঋতমের মা। দুপুরে ঘরের দরজা এঁটে ঘুমোচ্ছিলেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মহিলা বললেন, ‘‘বেশ করেছে, মেরেছে। নেশা করে, চুরি করে। আমাদের জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। পুলিশ ওকে ধরে জেলে ভরুক।’’ যদিও পুলিশ বলছে, নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে ভুল করেছেন ওই চিকিৎসক-পড়ুয়ারা।
আপনারা পুলিশে ফোন করলেন না কেন? শুভজিতদের দাবি, ‘‘আমরা হাসপাতালের অধ্যক্ষকে জানিয়েছিলাম। পুলিশকে তো তাঁর জানানোর কথা।’’ গোটা ঘটনায় বিরক্ত উল্টোডাঙা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘অধ্যক্ষ বলছেন, পুলিশের নম্বর তাঁর কাছে নেই। এটা হয় নাকি!’’ হাসপাতালের অধ্যক্ষ উৎপলেন্দু জানা অবশ্য বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। শুধু বললেন, ‘‘যা ইচ্ছে লিখে দিন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy