Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
অভিযোগ চিকিৎসায় গাফিলতি

ছেলের মৃত্যুর এক বছর পরে মামলা মায়ের

ঊনচল্লিশ বছরের যুবক। বিদেশে পড়াশোনা, তার পরে সেখানেই ১০ বছরের চাকরি জীবন। দেশে ফিরে গোয়ায় রিসর্ট চালুর তোড়জোড় করছিলেন। ডায়াবেটিক হলেও স্বাস্থ্য ভালই ছিল। বড়সড় কোনও সমস্যা ছিল না।

 নীলাব্জ ঘোষ

নীলাব্জ ঘোষ

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৬ ০০:৪৮
Share: Save:

ঊনচল্লিশ বছরের যুবক। বিদেশে পড়াশোনা, তার পরে সেখানেই ১০ বছরের চাকরি জীবন। দেশে ফিরে গোয়ায় রিসর্ট চালুর তোড়জোড় করছিলেন। ডায়াবেটিক হলেও স্বাস্থ্য ভালই ছিল। বড়সড় কোনও সমস্যা ছিল না।

যে দিন বিকেলে তিনি রক্তপরীক্ষা করালেন তার এক ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ফোন করে জানালেন, রক্তে ডেঙ্গি পাওয়া গিয়েছে। পরীক্ষা-রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেঙ্গি একেবারে প্রাথমিক স্তরে ছিল। এবং সেটা হেমারেজিক ডেঙ্গি নয়।

জ্বর নেই, কোনও শারীরিক সমস্যা নেই, প্লেটলেট কাউন্টও কমেনি। তা সত্ত্বেও ‘সতর্কতামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে তখনই ওই চিকিৎসক ওই যুবককে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে বললেন।

অভিযোগ, ভর্তি হওয়ার পরে টানা পাঁচ দিন চব্বিশ ঘণ্টা ডায়াবেটিক ওই যুবককে তিনি গ্লুকোজ স্যালাইন দিয়ে গেলেন। পঞ্চম দিন যুবকের দু’টি কিডনিই বিকল হয়ে যায়। ডায়ালিসিস করানোর সময়ে কোমায় চলে যান তিনি। পনেরো দিন কোমায় থাকার পরে মৃত্যু হয় যুবকের।

নিয়মানুযায়ী, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কেউ ভর্তি হলে বা কারও মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে কর্পোরেশনে তা নথিভুক্ত করানো হয়। ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গির কথা বলা হলেও কলকাতা পুরসভা তাদের রিপোর্টে (২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) জানায়, ওই যুবকের ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যু হওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল তাদের কাছে নথিভুক্ত করায়নি।

২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর ছেলের মৃত্যুর পরে এক বছরের বেশি সময় বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি তাঁর মা। স্বামী আগেই মারা গিয়েছিলেন। তার পর একমাত্র সন্তানের এই পরিণতিতে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন মা। পেশায় সলিসিটর ওই মহিলা কাজকর্মও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এক বছর পরে ২০১৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের শরণাপন্ন হন। ৪ এপ্রিল রাজ্য কমিশন নোটিস দিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসককে আগামী ১১ মে হাজিরা দিতে বলেছে। এর পাশাপাশি চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলেও অভিযোগ দায়ের করেছেন ওই মহিলা।

মৃত ওই যুবকের নাম নীলাব্জ ঘোষ। দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বসু রোডে বাড়ি। অভিযুক্ত চিকিৎসক হলেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট হর্ষ ভি অগ্রবাল। গড়চা ফার্স্ট লেনে তাঁর নার্সিংহোমের নাম ‘অল এশিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট।’ নীলাব্জ ঘোষের মা ঝর্ণা ঘোষের অভিযোগ, ‘‘সাধারণ ডেঙ্গি তো বাড়িতে রেখে চিকিৎসাতেই সেরে যায়। শুধু টাকা রোজগারের জন্য ওই চিকিৎসক অনাবশ্যক আমাদের ভয় দেখিয়ে ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তার উপরে এক জন ডায়াবেটিক রোগীকে টানা গ্লুকোজ স্যালাইন দিয়ে যান তিনি। এ তো খুনের সমান!’’

তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘গ্লুকোজ স্যালাইন চালুর দু’দিনের মধ্যে নীলের পেট এবং হাত-পা ফুলতে শুরু করে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অথচ ওর প্লেটলেট কাউন্ট ভালই ছিল। ৩১ নভেম্বর ২০১৪-এ টেস্ট করে দেখা যায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার প্লেটলেট।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমি বারবার হর্ষ অগ্রবালকে বলি, কোথাও কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। উনি কোনও গুরুত্বই দেননি। উল্টে সকাল-সন্ধ্যা আমাকে ফোন করে বলতেন ‘পেশেন্ট ভাল আছে। ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে।’ যে দিন পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যায়, সে দিন আমার সামনেই উনি বলে ফেলেন, নীল যে ডায়াবেটিক সে কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন এবং টানা গ্লুকোজ স্যালাইন চালিয়ে গিয়েছেন। এখন আমি কী করব? আমি তো পৃথিবীতে একা

হয়ে গেলাম!’’

ঝর্ণাদেবীর দাবি, যখন ডায়ালিসিস করতে গিয়ে নীলাব্জ কোমায় চলে যান, তখন চিকিৎসক হর্ষ তাঁকে জানিয়েছিলেন, এ ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ধরনের ডায়ালিসিস দরকার ছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থা তাঁর নার্সিংহোমে নেই। ফলে অন্য কোনও হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যেতে হবে। সেই মতো ৩ নভেম্বর ২০১৪ নীলাব্জকে আলিপুরের একটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা

হয়। কিন্তু কোমা থেকে তিনি আর ফেরেননি।

এ ব্যাপারে চিকিৎসক হর্ষ ভি অগ্রবালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি চিকিৎসার ব্যাপারে কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে আমরা বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, তা আইনি পথেই ঠিক হতে দেওয়া উচিত। কোনও মন্তব্য করব না।’’

সাধারণ ডেঙ্গির চিকিৎসা কী হয়ে থাকে?

প্রবীণ চিকিৎসক অমিয়কুমার হাটির কথায়, ‘‘যখন রোগীর কোনও সমস্যা নেই তখন বাড়িতেই থাকবে। তা ছাড়া, ডায়াবেটিক রোগীকে গ্লুকোজ স্যালাইন চালানোর ব্যাপারটায় বিস্তর গোলমাল ঠেকছে।’’ চিকিৎসা প্রক্রিয়ার বিষয়ে আর এক প্রবীণ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘‘আমি হলে প্রথম দিনই স্যালাইন চালাব না। আগে প্লেটলেট, পিসিবি, হিমোগ্লোবিন সব কেমন আছে দেখে, তার পরে সিদ্ধান্ত নেব স্যালাইন দেব কিনা। ডায়াবেটিক রোগী হলে সাধারণ স্যালাইন দেব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dengue dialysis fever
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE