ট্রাফিক পুলিশের তোলাবাজির সেই সব কার্ড।—নিজস্ব চিত্র।
লড়াইটা আসলে পুলিশের সঙ্গে পুলিশের। এক দল উর্দিধারীর ‘তোলা’র টাকা আর এক দল পায় না। এ নিয়ে ট্রাফিকের সঙ্গে থানার অলিখিত বিবাদ।
ভিজিটিং কার্ডের মতো ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। তাতে বটগাছ, ফুল, পাখি কিংবা আমের রঙিন ছবি। কাগজটা ছাড়পত্র। আর ছবিটা ‘প্রমাণ’ দেবে পুলিশের কোন ট্রাফিক গার্ড ছাড়পত্র দিয়েছে। মাসোহারা চুক্তিতে বিভিন্ন ট্রাফিক গার্ডের দেওয়া এই ধরনের কাগজ থাকলেই ট্রাক-ভর্তি মাল নিয়ে নির্বিঘ্নে যাওয়া যাবে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে। তা সে নিয়ম ভেঙে বাড়তি মাল নেওয়াই হোক বা কাগজপত্রের গরমিল, অন্তত কোনও ট্রাফিক পুলিশ ধরবে না সেই পণ্যবাহী ট্রাক-লরিকে।
কিন্তু থানার পুলিশ? তারাই বা ছাড়বে কেন? উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশ এবং ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট সূত্রেরই খবর, কিছুকাল আগে কয়েকটি থানার কার্ড নিয়ে গরু পাচারের লরির ছাড় পাওয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় শীর্ষকর্তাদের একাংশের কড়া নির্দেশে তড়িঘড়ি থানার প্রায় সব কার্ড বা ছাড়পত্র উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও থানার পুলিশের তোলা আদায় তাতে থামেনি বলে লরির চালক ও মালিকদের অভিযোগ। তাঁদের দাবি, থানার পুলিশ তাদের ‘হকের টাকা’ পেতে দাঁড়িয়ে থাকে এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন জায়গায়।
আর ট্রাফিক পুলিশকে ‘নজরানা’ দিয়ে চিরকুট হাতে পাওয়ার পরে থানার ‘বাড়ানো হাত’ এড়াতে যান বহু লরিচালক। চেষ্টা করেন দ্রুত ‘পালাতে’। তা করতে গিয়েই সোমবার সকালে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের রবীন্দ্রনগরে লরির ধাক্কায় চার নাবালক পিষ্ট হয়ে যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা তো অভিযোগ করছেনই, পুলিশের একাংশও স্বীকার করে নিচ্ছেন সে কথা।
পাশাপাশি ট্রাকচালক ও মালিকদের একটা বড় অংশ এটাও মানে, চালকদের অনেকেই নিয়ম ভেঙে অনুমোদিত ওজনের চেয়ে অনেক বেশি ওজনের মালপত্র লরিতে বোঝাই করেন এবং তাঁদের অনেকেরই সঠিক লাইসেন্স নেই! মূলত থানার পুলিশের তোলা আদায় থেকে রেহাই পেতে এবং নিজেদের অনিয়ম ধরা না পড়া নিশ্চিত করতে লরিচালকদের অনেকেই বেপরোয়া চালান। আর সে জন্যই বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সোমবার সকালের মতো দুর্ঘটনা যে কোনও সময়ে ফের ঘটতে পারে বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন লরিচালক ও মালিকদের অনেকেই।
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে তিনটি ট্রাক চলে, এমন এক মালিক মঙ্গলবার বলেন, ‘‘পুলিশের তোলা আদায় কোনও দিন বন্ধ হবে না। রবীন্দ্রনগরের মতো বড় ঘটনা ঘটলে কিছু দিন পরিস্থিতি থমথমে থাকবে, ব্যস। তার পরে যে-কে-সেই। এর চেয়ে থানাও আগের মতো মাসোহারা নিয়ে কার্ড সিস্টেম চালু করুক। তাতে অন্তত মানুষ খুনের পাপ বইতে হবে না।’’ এক চালকের বক্তব্য, ‘‘এক দিন মালিককে বললাম, আজ বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটা জায়গায় পুলিশ দু’হাজার টাকা নিয়েছে। তখন মালিক আর এক জন ড্রাইভারের নাম করে বলল, ‘ও তিনটে জায়গায় ফাঁকি দিয়ে আমার হাজার টাকার উপরে বাঁচিয়ে দিল। তুই পারলি না?’ জোরে না চালিয়ে কী করব বলুন!’’
ডানলপ থেকে বিরাটি পর্যন্ত বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের এই ৮ কিলোমিটার বালি, নিমতা, সোদপুর ও এয়ারপোর্ট ট্রাফিক গার্ডের এক্তিয়ারভুক্ত। ওই সব ক’টা ট্রাফিক গার্ডই ব্যারাকপুর কমিশনারেটের। ট্রাকচালকেরা জানান, মাসে বালি ট্রাফিক গার্ডকে ৭০০, সোদপুরকে ৫০০, নিমতাকে ৩০০ ও এয়ারপোর্ট গার্ডকে দিতে হয় ৫০০ টাকা।
ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহের যদিও দাবি, ‘‘এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এমন অভিযোগ জমা পড়েনি।’’ এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে বারাসতের দিকে যেতে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের বিভিন্ন ট্রাফিক গার্ডের আলাদা কার্ড লাগে। জেলার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘‘এমন মাসোহারা কার্ড নিয়ে সাম্প্রতিক কালে অভিযোগ ওঠেনি।’’
তবে পুলিশ যা-ই দাবি করুক, শাসক দল তৃণমূলেরই প্রভাবিত বারাসত ট্রাকচালক শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক বিকাশ গায়েন বলেন, ‘‘প্রতি মাসে ট্রাফিক গার্ডের মাসোহারা কার্ডের ছবি পাল্টে দেওয়া হয়। কিন্তু থানায় এখন সেই ব্যাপার নেই। তাই বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন থানার পুলিশ প্রায় ২৪ ঘণ্টাই লরি থেকে টাকা তোলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।’’ এমনকী সোমবারের দুর্ঘটনার পরে খোদ রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও বলেছিলেন, তিনি জেনেছেন, ঘাতক ট্রাকটির পিছনে একটি পুলিশের জিপ আসছিল। সম্ভবত চালক ভেবেছিলেন, তারা তোলা আদায়ের জন্যই পিছু নিয়েছে। সে কারণেই গতি বাড়িয়ে দেয় ট্রাকটি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।
শুধু বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উপরেই বরাহনগর, বেলঘরিয়া, নিমতা, দমদম এবং বিমানবন্দর থানার পুলিশ রোজ এক-একটি ট্রাক থেকে ২০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত তোলে বলে অভিযোগ চালকদের। বিকাশবাবুর যুক্তি, ‘‘চালকও চায় মালিকের টাকা কিছুটা বাঁচাতে। পুলিশকে এত টাকা দিলে তাকে চাকরিতে রাখবে মালিক?’’
ফেডারেশন অব ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন-এর যুগ্ম সম্পাদক প্রবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বেলঘরিয়ার এক্সপ্রেসওয়ের ঘটনা পুলিশের গাফিলতিতেই হয়েছে। গোটা রাজ্যে ট্রাকের উপরে পুলিশের এমন জুলুমের কথা আমরা বারবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলিশকর্তাদের জানিয়েছি। কোনও ফল হয়নি।’’ প্রবীরবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন করে নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ট্রাকমালিকেরা একাধিক বার পরিবহণ-কর্তা এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে দরবার করেছেন। তার পরেও কাজ হয়নি।’’ পরিবহণ দফতরের এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘ট্রাকের বাড়তি ভার বহন ধরার জন্য ২০১৩ সালে পুলিশকে পুরো ক্ষমতা দেয় সরকার। কারণ, ওভারলোডিংয়ে নজরদারির পরিকাঠামো পরিবহণ দফতরের ছিল না।’’
ওই কর্তারই অভিযোগ, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই পুলিশ লাগামছাড়া ‘তোলা’ আদায়ের কাজ শুরু করেছে। ফেডারেশন অব ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স-এর পক্ষ থেকে এ দিন জানানো হয়, পুলিশি জুলুম বন্ধ না হলে আগামী ২২ মার্চ থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ট্রাক-ধর্মঘটের পথে হাঁটবেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy