রাজারহাটের ধাড়সা মোক্তারপুর মৌজার জমি পাহারা দিচ্ছেন নিজামউদ্দিন মোল্লার অনুগামী বলে দাবি করা তিন যুবক। —নিজস্ব চিত্র।
বাবলা গাছের তলায় গাড়ি দাঁড়িয়েছে পাঁচ মিনিটও হয়নি। সাইকেলে চেপে দ্রুত চলে এলেন তিন যুবক। পরে আরও দু’জন। তাঁদের বক্তব্য একটাই, ‘প্রোজেক্টের জন্য জমি কিনতে হলে নিজামভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ রাজারহাটের বুকে এ-ও এক সিন্ডিকেট। জমি সিন্ডিকেটের সেই সাম্রাজ্যের ‘মাথা’ নিজামউদ্দিন মোল্লা জেলবন্দি হলেও দাপট অব্যাহত। মঙ্গলবার বিকেলের অভিজ্ঞতা অন্তত সে কথাই বলছে।
গত ২৫ জুলাই চিংড়িঘাটা থেকে নিজামউদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রাজারহাট থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো কাগজপত্র বানিয়ে একাধিক মানুষের জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ছিলই। পাশাপাশি, গত মে মাসে পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে নিজামের বিরুদ্ধে মারধর, ছিনতাই, অস্ত্র আইন-সহ খুনের চেষ্টায় মামলা রুজু হয়। বস্তুত, গুরুতর অভিযোগে রাজারহাট থানায় বারবার মামলা রুজু হলেও ‘জমি হাঙর’ বলে পরিচিত ওই ব্যক্তির জামিন পেতে অসুবিধা হয়নি। এর পিছনে পুলিশের একাংশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দায়ী বলে অভিযোগ ধাড়সা মোক্তারপুর, বসিনা, জামালপাড়া, জগদীশপুর, রেকজোয়ানি, মহম্মদপুরের বাসিন্দাদের। সেই অভিযোগের আবহেই মঙ্গলবার বিকেলের অভিজ্ঞতা তাৎপর্যপূর্ণ।
অ্যাকশন এরিয়া টু-বি চৌমাথা থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলে ডিভাইডারের উপরে একটি বাবলা গাছ রয়েছে। তার সামনে ধাড়সা মোক্তারপুর মৌজার বিস্তীর্ণ শালি জমি। বাবলা গাছের তলায় বসে থাকা যুবকদের দাবি, নিজামউদ্দিনের নির্দেশে তাঁরা সেখানে ডিউটি করছেন। কীসের ডিউটি? আকবর আলি নামে এক যুবকের কথায়, ‘‘দেশ-বিদেশ যেখান থেকেই পার্টি আসুক, এখানে জমি দেখে সকলের পছন্দ হয়ে যায়। তাঁদের যাতে কেউ ভুল বোঝাতে না পারে, সে জন্য নিজামভাই ডিউটিতে রেখেছেন! মহম্মদপুরেও ডিউটি করি। (আবাসন) প্রোজেক্টের জন্য জমি নেওয়ার আগে নিজামভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতেই হবে। ভাইকে না বললে জমি মিলবে না। সে যত বড় প্রোজেক্টই হোক না কেন!’’
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ ভাবেই দীর্ঘদিন ধরে ভয় দেখিয়ে অন্যের জমি হাতিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেছেন নিজাম। স্থানীয় সূত্রের খবর, ‘জমি হাঙরে’র দাপটে রাজারহাটের ওই অঞ্চলে আবাসন গড়তে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। সাধে কি আর আকবরেরা বলছেন— ‘রাজারহাটে টপ দালাল হলেন নিজাম। কয়েকশো কোটি টাকার মালিক! বড় বড় শিল্পপতিকে জিজ্ঞাসা করবেন, নিজামকে চেনেন? নাম শুনেই বলবেন, চিনি!’ কথাটা বলার সময়ে ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন ভাইয়ের অনুগামীরা।
এই হাসির অর্থ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন রহিম বক্স মোল্লা, সত্যেন মণ্ডলেরা। জমির একাংশ রেজিস্ট্রি করানোর নামে রহিমবাবুর পুরো জমিই নিজাম হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ। রহিমের স্ত্রী বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন কেস চালিয়ে ওঁর অর্থবলের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।’’ সত্যেনের বক্তব্য, ‘‘আমার জমি মিউটেশন পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছিলেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তা বাতিল হওয়ার পর থেকে ওঁর অনুগামীরা নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছেন।’’ রেকজোয়ানির এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘পুলিশ সক্রিয় হলে নিজামের এত বাড়বাড়ন্ত হত না। ওঁর অর্থবলের কাছে সকলে চুপ। থানায় কম স্মারকলিপি তো দেওয়া হয়নি। এ বারও না পার পেয়ে যায়!’’
ঘটনাচক্রে, আজ, বৃহস্পতিবার নিজামের জামিনের শুনানি হওয়ার কথা। তার আগে মঙ্গলবার তাঁর এক অনুগামী বলেন, ‘‘নিজামভাইয়ের নম্বর নিয়ে নিন। তবে এখন পাবেন না। ভাই বাইরে গিয়েছেন। তিন দিন পরে ফোন করবেন, পেয়ে যাবেন!’’
জেলবন্দি হয়েও নিজামের এই ‘সক্রিয়তা’ প্রসঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলেন, ‘‘কোনও ব্যবসায়ী জমি কিনতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন, এমন অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে পুলিশকে বলব খতিয়ে দেখতে। ওঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি রয়েছে, পুলিশ নিশ্চয় তার তদন্ত করছে।’’ স্থানীয় সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, ‘‘কে নিজামউদ্দিন, কোথায় মহম্মদপুর তা-ও জানি না! এ সব বিষয়ে আমি জানি না। আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না।’’
বিধাননগর সিটি পুলিশের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘জমি কেনাবেচায় বাধা দেওয়ার কোনও অভিযোগ পেলে পুলিশ তার সত্যতা যাচাই করে যথাযথ পদক্ষেপ করবে।’’
কলকাতার ঘটনা এবং দুর্ঘটনা, কলকাতার ক্রাইম, কলকাতার প্রেম - শহরের সব ধরনের সেরা খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy