প্রাণবন্ত: বছরভর মেজাজটা থাকে এমনই। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ব্যস্ত শহরটার বুক চিরে একটা গলি শুধুই ছুটির! হারিয়ে যাওয়া ক্যালকাটার স্বাদ মেলে এখনও সেখানে মাঝেমাঝে।
রাস্তার ধারে ছোট্ট খাবারের দোকান। সামনে পাতা চেয়ার-টেবিলে দশ মিনিটের অপেক্ষায় পৌঁছে যেতে পারে টর্টিলা দা পতাতা বা তোফু সিজার স্যালাড। পাশের টেবিলে রুদ্রাক্ষের মালা গলায় বিদেশিনির দল, খানিক আলাপ জমানোর চেষ্টায় মানানসই সসের বোতলটা এগিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আগামী দিন কয়েক সুন্দরবন না কি ভয় কাটিয়েই দার্জিলিং, সে সব কথায় কখন যেন সহজেই বন্ধুত্ব জমে যাওয়া দুধ-কর্নফ্লেক্সের জার্মান তরুণী কিংবা রুকস্যাক পিঠে শিশু কোলে নাইজিরীয় মায়ের সঙ্গে।
চিরচেনা শহরটার মধ্যে সত্যি আজও আছে এমন একটা কলকাতা। যেখানে কলকাতা মানে শুধুই হিন্দু বাঙালি নন। এখনও বছরের কয়েকটা সময় সেখানে জাত-ধর্ম মিলেমিশে হইচই, হট্টগোল। আপন শহরে বসেই যেন সহজে বিশ্ব ভ্রমণের আহ্লাদ মেটানোর একটা ঠিকানার নাম এই গলি। সদর স্ট্রিট।
ভারতীয় জাদুঘরের ঠিক পিছনেই যেন এক অন্য জাদু। নিউ মার্কেট থেকে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক পা এগোলেই হল। হঠাৎ করেই প্রবেশ ঘটবে বিশ্বের দরবারে।
শহরে আসা বিদেশি পর্যটকদের ঘিরেই এখানে গড়ে উঠেছে এক অন্য সংস্কৃতি। নানা রং, বিভিন্ন রুচি, রকমারি সাজের মানুষজনে বছরভর জমজমাট এই পাড়া। কলকাতা দেখতে আসা বিদেশিদের প্রয়োজন মতো জিনিসের জোগান দিতে এই গলি জুড়ে এখন নানা মেজাজের হোটেল-রেস্তোরাঁ-স্পা। সঙ্গে দিনভর হইচই।
সে রাস্তারই এক প্রান্তে এখনও হুল্লোড় হয় ঝলমলে সাহেবি কায়দার বিয়ার লনে। বেতের চেয়ারে বসে আজও একা হাতে ঐতিহ্য আগলে রাখেন কলোনিয়াল সাজের মেমসাহেব। সূর্য ডুবতেই সেখানে ঢল নামে নানা রঙের মানুষের। ঘড়ি ধরে চালু হয়ে যায় পার্টি টাইম। কে বলবে বাকি শহর তখনও কম্পিউটারের পর্দায় মুখ গুঁজে খটখট করে সারছে রোজের কাজ অথবা পরদিনের বাজার সেরে ভিড় বাসে কোনওমতে সবে হয়েছে বাড়িমুখো! এ পথ যে চলে শুধুই ছুটির নিয়মে। এখানে কাজও তাই ছুটি ঘিরেই। বিদেশিদের কলকাতার ছুটি কী ভাবে আরও আনন্দের হয়ে উঠবে,
তা দেখতেই এখানে রকমারি জামা-জুতো-গয়না-খাবারের দোকান। তবে সেখানকার ফ্যাশনও ভ্রমণ-রুচির। সে সব দোকানের জিনিসপত্রের সঙ্গে বিশেষ মিল নেই বাদবাকি কলকাতার।
সরু গলির দু’ধারে রয়েছে আরও নানা হাতছানি। বিলিতি ধাঁচের সেই খাবারের ঠেক থেকে বেরোতেই আড্ডা স্বমহিমায় টেনে নিয়ে যাবে রাস্তার উল্টো দিকের পুরনো ইউরোপীয় মেজাজের পাব-এ। সন্ধ্যা শেষে রাত নামতেই যখন গমগমে হয়ে ওঠে তার অন্দর, ইটের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে টিমটিমে হলুদ আলো মনে করাতেই পারে ডিকেন্সের উপন্যাসের কোনও এক ট্যাভার্নের গপ্পো।
বিদেশিদের থাকার মতো মূলত সস্তা হোটেল ঘিরেই এখনকার অভিনব মেজাজ পেয়েছে সদর স্ট্রিট। তাতে যত কম বাঙালিই দেখাক না কেন এই গলি, বাঙালিয়ানার সঙ্গে এখানকার যোগ বহু কালের এবং খুবই কাছের। শোনা যায় ১০, সদর স্টিটে কাদম্বরীদেবীর বাড়িতে বসেই ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি লিখেছিলেন রবি ঠাকুর। সে কালের সদর স্ট্রিটের সঙ্গে চরিত্রগত তেমন কোনও মিল নেই এ কালের ছুটিকেন্দ্রিক এই বর্ণময় গলির। প্রথাগত রবীন্দ্রচর্চার সামান্য ছোঁয়াও আপাতভাবে চোখে পড়বে না এখানে। তবে এ শহরের হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র অঞ্চলের মধ্যে এ গলিও বুঝি পড়ে, যেখানে বইয়ের পাতায় নয়, জীবনচর্যায় ফুটে ওঠে বিশ্বকবির ভাবনা। নয় তো এত বৈচিত্র সামলে আনন্দে থাকা কি সহজ কথা এ সময়ে কোনও শহরেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy