Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

রাতের শহরে ধুন্ধুমার বন্দুকবাজিতে মৃত্যু, নেপথ্যে সেই সিন্ডিকেটের আঁচ

এমনই একটা কিছুর আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। অনেক আগেই। এলাকায় জমি-ইমারতির সিন্ডিকেটের লড়াই যে এক দিন মারণ চেহারা নিতে পারে, হরিদেবপুর থানার ওই সাব ইন্সপেক্টর তার আঁচ পেয়েছিলেন। যে কারণে সাত মাস আগে বিবদমান দুই সিন্ডিকেটকে শায়েস্তা করতে তিনি কোমর বাঁধেন।

হরিদেবপুরের সেই পানশালা

হরিদেবপুরের সেই পানশালা

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ০৪:১৮
Share: Save:

এমনই একটা কিছুর আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। অনেক আগেই।

এলাকায় জমি-ইমারতির সিন্ডিকেটের লড়াই যে এক দিন মারণ চেহারা নিতে পারে, হরিদেবপুর থানার ওই সাব ইন্সপেক্টর তার আঁচ পেয়েছিলেন। যে কারণে সাত মাস আগে বিবদমান দুই সিন্ডিকেটকে শায়েস্তা করতে তিনি কোমর বাঁধেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নিয়ে উঠতে পারেননি। কারণ, আচমকা এক ঘণ্টার নোটিসে তাঁকে সরিয়ে দেয় লালবাজার।

এখন পুলিশ-ই বলছে, ওঁর আশঙ্কা শেষমেশ সত্যি হয়েছে। বুধবার রাতে হরিদেবপুরের কবরডাঙা মোড়ের এক পানশালার সামনে ধুন্ধুমার বন্দুকবাজি হয়েছে, বোমা পড়েছে বৃষ্টির মতো। অন্তত ৩৫ রাউন্ড গুলি চলেছে, যাতে মারা গিয়েছেন রাহুল মজুমদার ওরফে রাজা (২৪) নামে এক যুবক। জখম দুই অটোচালক— সঞ্জয় ছেত্রী ও উত্তম সাহা। রাহুলের মা জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে সিন্ডিকেট-ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে, তারাও জমি-সিন্ডিকেটে জড়িত বলে পুলিশের দাবি। এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে এক জন। বিজয় ভৌমিক নামে ছেলেটি ঘটনার পরেই পানশালার সামনে পাকড়াও হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, হামলার সময়ে কিয়স্কের নিরস্ত্র পুলিশ মুখ গুঁজে ছিল, মোড়ে মোতায়েন পুলিশকর্মীরাও গা ঢাকা দেন। অবাধে চলে সন্ত্রাস।

এর জেরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ব্যাপক। বৃহস্পতিবারও এলাকা থমথমে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর: কবরডাঙার ওই এলাকাটি আগে ছিল জোকা ১ ও ২ নম্বর পঞ্চায়েতের অধীনে। এখন কলকাতা পুরসভার আওতায় আসায় জমির দর হু-হু করে চড়েছে। পরিণামে জমি ঘিরে সিন্ডিকেটের রমরমা
শুরু হয়েছে। এলাকা দখলের লড়াইও জোরদার।

এবং সিন্ডিকেট-রাজের পিছনে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার ইঙ্গিতও মজুত। পুলিশ-সূত্রের দাবি: স্থানীয় বরো চেয়ারম্যান ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্য, কাউন্সিলর রঘুনাথ পাত্র (দু’জনেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত) এবং স্থানীয় তৃণমূল নেতা শুভাশিস চক্রবর্তীর গোষ্ঠীর মদতেই এই কারবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। শোভনবাবু ও শুভাশিসবাবু দু’জনেই অবশ্য বুধবারের অশান্তিতে সিন্ডিকেট-যোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, এ সব নিছক পানশালার গোলমালেরই পরিণতি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও একমত। ‘‘ওরা কোনও ভাবেই সিন্ডিকেটের কেউ নয়।
মাতাল কিছু লোক নাইট ক্লাবে গোলমাল পাকিয়েছে।’’— বলেন পার্থবাবু। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হরিদেবপুরে অত ফ্ল্যাট কোথায় যে, সিন্ডিকেট হবে? যদি হয়ও, কেউ নিস্তার পাবে না। কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।’’

রঘুনাথবাবু ও ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তাঁরা ফোন ধরেননি, এসএমএসের জবাব দেননি। কবরডাঙায় ঠিক কী ঘটেছিল?

পুলিশ জানাচ্ছে, কয়েকটি ছেলে বারের গায়িকা-নর্তকীদের সঙ্গে নাচ-গান করতে চায়। তা নিয়ে বাউন্সারদের সঙ্গে ঝামেলার সূত্রপাত। তখন রাত প্রায় দশটা। ছেলেগুলো চলে যায়। খবর পেয়ে হরিদেবপুর থানার পুলিশও এসে ঘুরে যায়। পানশালার সামনের কিয়স্কে দু’জন পুলিশ আর রাস্তায় মোটরবাইক-টহলদার মোতায়েন হয়।

কিন্তু রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কয়েকটি অটোয় চেপে এসে চড়াও হয় জনা দশেক যুবক। তারা এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন রাহুল ওরফে রাজা। সামনের অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম ও সঞ্জয়ের হাতে গুলি লাগে। হাসপাতালে চিকিৎসা করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ঠাকুরপুকুরের বিশ্বাসপাড়ার বাসিন্দা রাহুলের মা আরতিদেবী জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে সিন্ডিকেটের কারবারে যুক্ত ছিল। ওঁর দাবি, রাজাকে কারবারে নামান তৃণমূলের এক কাউন্সিলর ঘনশ্রী বাগ। বুধবার রাতে রাজাকে ফোন করে ওই পানশালার সামনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল বলে আরতিদেবী জানিয়েছেন। যা শুনে ঘনশ্রীবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘রাজা সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিল কি না জানি না। তবে এলাকায় বাড়িঘর তৈরি হলে ও ইমারতির জিনিসপত্র সাপ্লাই করত।’’ তৃণমূল-সূত্রের খবর, ঘনশ্রীবাবুও মেয়রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

অন্য দিকে, কলকাতা পুলিশের বেহালা ডিভিশনের ডিসি রশিদ মুনির খান এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘রাজা এই পানশালার নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। পানশালা খোলা না-পেয়ে সিগারেট কিনতে যাচ্ছিলেন। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।’’ পানশালার উল্টো দিকের এক দোকানদারের কথায়, ‘‘ছেলেটি রোজ আমার দোকানেআসত। বুধবার রাতে আসার সময় হঠাৎ চিৎ হয়ে পড়ে গেল। আমি বেরোতে গিয়ে দেখি, বাইরে গুলি চলছে। ভয়ে শাটার নামিয়ে দিলাম।’’

হামলা চালাল কারা?

প্রাথমিক তদন্তে নান্টি, কাঞ্চা, বাপ্পার মতো কয়েকটি নাম উঠে এসেছে, যাঁরা কি না স্থানীয় এক সিন্ডিকেটের চাঁই ডাবলু সিংহের লোক বলেই তদন্তকারীদের দাবি। পুলিশের দাবি, ধৃত বিজয়ও ডাবলু-গোষ্ঠীর সদস্য। গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ এ দিন জানান, গুন্ডামির অভিযোগে নান্টি গত সেপ্টেম্বরেই গ্রেফতার হয়েছিল।

পাশাপাশি সামনে এসেছে স্থানীয় থানার সঙ্গে দুর্গা সিংহ-কালী সিংহ গোষ্ঠীর ‘মাখামাখি’র অভিযোগও। লালবাজার-সূত্রের খবর: দুর্গা ও কালী— দু’ভাই মিলে জমি-ইমারতির সিন্ডিকেট চালায়। একই সঙ্গে বকলমে পানশালাটিও চালায়, যদিও খাতায়-কলমে সেটির মালিক অন্য তিন ব্যক্তি। লালবাজারের দাবি, পানশালাটির আবগারি লাইসেন্স থাকলেও পুলিশি অনুমোদন নেই। তা সত্ত্বেও সেটি দিব্যি চলছিল স্থানীয় থানার নাকের ডগায় বসে!

তৃণমূলের অন্দরে দুর্গা-কালীর পরিচয় রঘুনাথ পাত্র ও ইন্দ্রজিৎ ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে। অন্য দিকে ডাবলু সিংহ শুভাশিসবাবুর কাছের লোক বলে পুলিশের একাংশের দাবি। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের একটি মহলের মতে, বুধবারের হামলা আদতে দুর্গা-কালী বনাম ডাবলু গোষ্ঠীর সিন্ডিকেট-দ্বন্দ্বের পরিণতি। ‘‘বারের গোলমাল আসলে ছুতো। প্রতিদ্বন্দ্বীদের শিক্ষা দিতেই ডাবলুর দলবল চড়াও হয়েছিল।’’— মন্তব্য এক অফিসারের।

প্রসঙ্গত, দুর্গা-কালীর বাড়ি ওই পানশালার পাশেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেও বলছেন, ছেলেগুলো যে ভাবে গুলি ছুড়ছিল, তাতে বারের নাচ-গান নিয়ে ঝামেলার তত্ত্ব ধোপে টেকে না। এক বহুতল বাজারের তিনতলায় ওই পানশালা। দুষ্কৃতীরা বাজারের ভিতরে ঢোকেইনি। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বাজারের গায়ে তৃণমূলের একটা অফিস আছে। হামলার সময়ে কালী সেখানেই ছিলেন। রাজার সঙ্গেও কালীর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।

এমতাবস্থায় এলাকার অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, বুধবার রাতে রাজার সঙ্গে কালীও ছিলেন আততায়ীদের নিশানায়। ডাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে শুভাশিসবাবু ফোনে বলেন, ‘‘আমাকে অপমান করতেই এ সব অভিযোগ। আমি আইনজীবী। অপরাধীদের সঙ্গে সংশ্রব নেই।’’ আর কালী সিংহের বক্তব্য, ‘‘বারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। গুলি চলেছে শুনে ছুটে আসি।’’

এখন প্রশ্ন উঠেছে, শাসকদলের ছায়া থাকাতেই কি পুলিশি অনুমোদনহীন পানশালা থানার নজর এড়িয়ে গেল? লালবাজারের কর্তারা মুখ খুলতে চাননি। হামলা রুখতে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ প্রসঙ্গে তদন্তের কথা বলেই দায় সেরেছেন তাঁরা। লালবাজারে এ দিনের জরুরি বৈঠকে পুলিশ কমিশনার বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিলেও রাত-পাহারার পুলিশের হাতে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE