প্রতীকী ছবি।
স্কুল থেকে ফিরে মুখ ভার করে বসে থাকে সৃষ্টি। কী হয়েছে, জিজ্ঞেস করলে তো উত্তর মেলেই না, উল্টে কখনও রেগে চিৎকার করে ওঠে তৃতীয় শ্রেণির মেয়েটা। বাধ্য হয়েই কোনও দিন উপহার দিয়ে, কোনও দিন ঘুরতে নিয়ে গিয়ে মেয়ের ‘মুড’ ফেরান মা।
সবে প্রথম শ্রেণিতে ওঠা রূপসা আবার সকালে স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই সিঁটিয়ে যায়, কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। তাড়াহুড়োর সময়ে ধৈর্য্য হারান মা, এক রকম বকেঝকেই মেয়েকে তৈরি করে স্কুলে পাঠান তিনি। অথচ ক’দিন আগে পর্যন্তও স্কুলে যাওয়া নিয়ে উৎসাহের শেষ ছিল না মেয়ের।
পরিবারের খুদে সদস্যের এমন সব আচরণ অনেক সময়েই দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে অভিভাবকদের কাছে। কখনও আদরে, কখনও বা শাসনে তাঁরা ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা করেন সন্তানকে। তাতে হয়তো আপাত ভাবে কাজ হয়, তবে অস্বস্তির কারণটা না জানাই থেকে যায়। মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, শিশুমনকে সব চেয়ে ভাল বুঝতে পারেন তার বাবা-মা। তাই তাদের আচরণে কোনও পরিবর্তন ঘটলে, তা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার দায়িত্বও তাঁদেরই।
খেয়াল রাখুন
• পরিচিত কাউকে নিয়ে সন্তান অস্বস্তি প্রকাশ করলে, কারণ বোঝার চেষ্টা করুন। আগেই বকাবকি করবেন না।
• সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন, যাতে সমস্যায় পড়লে সে খুলে বলতে পারে।
• আশপাশে যে ‘দুষ্টু লোক’ আছে, তা সন্তানকে বুঝতে শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবককেই।
• ছোট থেকেই সন্তানকে ভাল স্পর্শ-খারাপ স্পর্শের ফারাক বুঝতে শেখান। এর জন্য সাহায্য নেওয়া যায় কার্টুন বা ছবির।
শুক্রবার দক্ষিণ কলকাতার জি ডি বিড়লা স্কুলে চার বছরের শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশিই চিন্তিত অভিভাবকেরা। যৌন নির্যাতন নিয়ে আগে থেকে সন্তানকে কী ভাবে সতর্ক করবেন তাঁরা? সন্তানের সঙ্গে এমন কিছু হলে কী ভাবে বুঝবেন, কী ভাবেই বা সামলাবেন পরিস্থিতি? কারণ নিরাপত্তার সব রকম বজ্র আঁটুনির পরেও বারবার ফস্কা গেরোর মাসুল দিচ্ছে খুদেরা। কখনও স্কুলে, কখনও টিউশনে কখনও বা স্কুলগাড়িতে।
এ দিনের ঘটনায় না-হয় শারীরিক ভাবে চরম নির্যাতিত শিশুটি। ইউনিফর্মে রক্তের দাগ বুঝিয়ে দিয়েছে সবটা। কিন্তু মনোরোগ চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, অনেক সময়ে নির্যাতনের কথা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তাই সন্তানের আচরণে সামান্যতম পরিবর্তন দেখলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হওয়া উচিত।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম মনে করেন, আগে সন্তানের কথা বিশ্বাস করতে শিখতে হবে বাবা-মায়েদের। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা-মায়েদের অনেক সময়েই মনে হয়, সন্তান যা বলছে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়।’’ বাস্তব চিত্র বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়ায় বাচ্চারা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। তার উপরে বাবা-মায়ের অবিশ্বাস তাকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
সমস্যা তো নতুন নয়। নতুন নয় সচেতনতার দাবিও। এই বিষয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। ছোট্টবেলা থেকে শিশুকে সচেতন করতে, তাদের বোঝার মতো করে তৈরি হয়েছে ‘গুড টাচ-ব্যাড টাচ’-এর মতো অ্যানিমেশন ফিল্ম। হাল আমলের মূল ধারার হিন্দি ছবি দেখিয়েছে, বাবার বন্ধুও কখনও হয়ে উঠতে পারেন আতঙ্কের কারণ। ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় উচ্ছ্বল তরুণী বীরার চরিত্রে সে কথাই বলেছিলেন আলিয়া ভট্ট। ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতেও মীরা নায়ার দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে দশ বছরের খুদের বিশ্বাস যৌন নির্যাতনের আঘাতে ভেঙেছিল তার খুবই কাছের জন।
বস্তুত, ছোটবেলায় কোনও না কোনও কাছের আত্মীয়ের হাতে অন্তত এক বার যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়নি, দেশ-কাল-জাতি নির্বিশেষে এমন শিশু প্রায় বিরল। এর প্রধান কারণ, শিশুরা সহজ ‘টার্গেট’। তারা ভয় পাবে, লজ্জা পাবে, প্রতিবাদ করবে না। এই সুযোগই নেন অনেকে।
বালিগঞ্জের বাসিন্দা সুতপা বসাক যেমন জানাচ্ছেন, চারপাশে সব দেখেশুনে রীতিমতো আতঙ্কিত তিনি। তিনি বলছেন, ‘‘সব রকম জড়তা-অস্বস্তি কাটিয়ে এখন মেয়েকে ভাল স্পর্শ আর খারাপ স্পর্শের পাঠ শেখাচ্ছি।’’ মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করেন, পরিবার কিংবা প্রতিবেশী কেউ আড়ালে আদর করতে চাইলে যে সে ভাল নয়, তা শেখাতে হবে অভিভাবককেই। এমন কোনও ঘটনা ঘটে গেলে তারা যাতে বাবা-মাকে জানাতে পারে, সেই আশ্বাসের জায়গা তৈরি করা জরুরি।
এমন পরিস্থিতি এড়াতে মনোরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গের মত, শিশুদের খেলনা কিংবা প্রিয় কার্টুন চরিত্র দিয়ে বাবা-মা যৌন নির্যাতন নিয়ে আগাম শিক্ষা দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘‘পুতুল কিংবা কার্টুন দেখিয়ে নানা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে বলতে হবে, ওই চরিত্রগুলো এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। এর জেরে শিশুরা ওই চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেদের মিল খুঁজে পায়। ফলে সে বাবা-মাকে এ বিষয়ে সহজেই বোঝাতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy